সংগী যখন দুর্বল ব্যক্তিত্বের পুরুষ

কাজী তামান্না কেয়া:

সম্পর্ক কী? আমিতো বলি সম্পর্ক এক পোষাক মাত্র। একই পোষাক সারা জীবন পরতে চাইলে পোষাকটিকে মানে অন্য পক্ষকে সমমনা হতে হবে মানে পোষাকটিকে টেকসই হতে হবে। তেমনই নিজের শরীরের মাপও অর্থাৎ নিজের রুচি, পছন্দ, ব্যক্তিত্ব একই থাকতে হবে। নিজে খুব মোটা হয়ে গেলে যেমন পোষাকটি গায়ে আঁটবে না আবার খুব চিকন হয়ে গেলেও সেই পোষাকে ব্যক্তিকে দেখতে সুন্দর দেখাবে না। তাই সম্পর্ক নামক পোষাকটি একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয়।

কাজী তামান্না কেয়া

ধরা যাক, নারীটি শিক্ষিত, প্রখর ব্যক্তিত্বের এক কর্মজীবী নারী, আর পুরুষটি আটপৌরে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজাধারী। তিনি চান নারী ঘরে এসে রাঁধবে, তার মোজা কিংবা রুমালের খোঁজ রাখবে, সন্তানের লেখাপড়ার দিকে নজর রাখবে, আবার তার মায়ের প্রেশারের ঔষুধ খাইয়ে দিবে নিয়ম করে। এই সম্পর্কে ভাঙ্গন প্রায় সুনিশ্চিত।
জোড়াতালি দিয়ে বড়জোর কয়েক বছর এগোতে পারবে। আর সম্পর্ক যদি চলেও, তাতে না থাকবে প্রান, না থাকবে সেই সম্পর্ক টেনে নেয়াতে কোন আনন্দ। বাস্তবে, রান্নার কাজ করার লোক পাওয়া যায় অথবা দুজনকে ভাগাভাগি করেই রান্নার দায়িত্ব নিতে হবে, মায়ের ঔষধ খাওয়ানোর দায়িত্ব আর সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব পুরুষকেই নিতে হবে। কারণ সংসার নামক গুহায় এতো কাজ নারীকে করতে হয়, এতো দিকে খেয়াল রাখতে হয়, যে একজন উচ্চ পেশার/পরিশ্রমের নারীর পক্ষে বাকি কাজগুলি করা সম্ভব নয়।
এতে যদি স্বামীর পৌরুষে আঘাত লাগে, স্বামী কী করবেন? দোষ কী তার? তার কল্পনায় তো ছিল নারী মানেই স্বামীর ঘর-সংসার, সন্তান, স্বামীর বাবা মা এবং সর্বোপরি স্বামীর দায়িত্ব নেবেন। সেই সাথে সাথে উচ্চ বেতনে, উচ্চ পদে, উচ্চ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকবে এবং সবশেষে সেই বেতন স্বামীর হাতে এনে দিবে অথবা বেতনের সব টাকা স্বামীর পরিবারের পেছনে খরচ করবে।

দুঃখিত ভাইয়া। আপনি যদি এই গোত্রের পুরুষ হয়ে থাকেন তবে আপনার জানায় ভুল আছে। নারী আপনার পিতামাতা, সংসার এবং আপনাকে দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব নিতে বিয়ে করেনি। কী ভাবছেন? আপনার পিতামাতা কি নারীটির শ্বশুর শাশুড়ি নয়? তবে কেন তাদের দেখেশুনে রাখবে না?
ভাইয়া, আপনার বাবা-মা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন এবং লালন পালন করেছেন, আপনার স্ত্রীকে নয়। তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব তাই আপনার নিজের, আপনার স্ত্রীর নয়।

এবার আসুন দেখি, নারী কীভাবে আপনার দায়িত্ব নেয়। ভাইজান, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষ মানেই আপনি নিজেও এক বিরাট খোকা। বেশিরভাগ সময়ে আপনার রুমাল, মোজা, চশমা পর্যন্ত নারীকে খুঁজে দিতে হয়, আপনি তিনবেলা টেবিলে খাবার সাজানো চান এবং ধোওয়া ও আয়রন করা পোষাক আশা করেন।
ভাবছেন বিয়ে হয়েছে ৫ বছর, আপনার আর আপনার পরিবারের দায়িত্ব না নিয়ে স্ত্রী যাবে কোথায়? আপনার মা, ফুপুরা এসব দায়িত্ব পালন করেই সংসার করেছে, এসব মেনেই সংসার করতে হয়, অন্তত আপনি তাই জেনে আর দেখে আসছেন। তবে কি আপনি ভুল জানেন?

আপনি আসলে ভুল জানেন। সময় বদলে গেছে অনেকখানি। আপনার কর্মজীবী স্ত্রীর নিজের জন্যে অনেকখানি সময় লাগে। এবার আসুন দেখি সংসারের সব দায়িত্ব কিংবা উধিকাংশ দায়িত্ব নেয়া নারীটির সামনে আপনার অবস্থান কোথায়। সত্যি কথা বলতে, সংসারের সব বা অধিকাংশ দায়িত্ব এই কর্মজীবী (পড়ুন সিংহী) নারীর উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে আসলে তুচ্ছ কিছুতে পরিণত হয়েছেন। যদি চিন্তার স্বচ্ছতা থাকে, তবে বুঝতে পারবেন, কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে। নিজের কাছে নিজেকে এতোই ক্ষুদ্র ভাবতে শুরু করেছেন যে, ঘরে ফিরতে এবং নিজ স্ত্রীর সামনে দাঁড়াতে আপনার লজ্জা লজ্জা লাগছে। নিজের মায়ের কাছে যেয়ে ঔষুধ খেয়েছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করতেও কেমন সংকোচ লাগছে। বাচ্চা স্কুলের হোমওয়ার্ক করেছে কী করেনি, আপনি তা জানেন না, এবং স্ত্রীকে সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই এক রামঝাড়ি খেয়ে টিভি বা পত্রিকার পাতায় মুখ লুকিয়েছেন। ফলাফল? ঝাড়ি দেয়া এই নারীকে আপনার আর ভালো লাগছে না। আপনি নিজ স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের সাথে পেরে উঠছেন না। কিছুতেই আর নিজ স্ত্রীর মন পাচ্ছেন না। আপনি তখন এই সমস্যার এক সহজ সমাধান চান।

কী সেই সমাধান যা না পেয়ে আপনি হাঁপিয়ে উঠেছেন? আপনার খুব সম্ভবত একটু সস্তা আর চটুল সম্পর্ক খুঁজছেন–আপনার চেয়ে বয়সে অনেক কম, পড়ালেখায় অনেক কম, জীবন মানে কম, কিংবা জীবন সম্পর্কে অনেক অজ্ঞ এমন কাউকে খুঁজছেন। ফেসবুকে সিঙ্গেল নারীদের নক করছেন কিংবা অফিসের ডিভোর্সি নারী সহকর্মী একা সন্ধ্যায় কী করে কাটায় তার খোঁজ নিচ্ছেন।

মোট কথা, আপনি এক নাটোরের বনলতা সেন খুঁজছেন যে দু’দণ্ড শান্তি দেবে আপনাকে। আর এখানেই ইতি ঘটে আপনার এতোদিনের মানসিক দ্বন্দ্বের, শেষ হয় একটি সিংহ নারী আর দুর্বল নরের দীর্ঘদিনের সংসার, আর জন্ম নেয় আরেকটি সম্পর্কের, যেখানে নতুন সংগী পুতুলমাত্র আর আপনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.