পুরস্কার!

ফাহমিদা খানম:

“শুধু তোমার জন্যেই সবাইর সামনে ছোটো হয়ে থাকতে হয়, বাবা সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমরা বিব্রত হই”
“দুজন প্রাপবয়স্ক মানুষের মাঝে বনিবনা হয়নি বলে তারা আলাদা হয়েছে, এখানে আমার দিকটাকেই বড়ো করে কেনো দেখছো ধ্রুব?”
“সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্যে নিজেকে ভোঁতা করে কেনো রাখলে না? রিয়ার বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে ব্রোকেন ফ্যামেলির ছেলের সাথে তিনি সম্বন্ধ করবেন না”
“তোমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, আর তুমি কি এসব ওকে আগে জানাওনি? এতো বছর বাদে এসব পুরানো কাসুন্দি কেনো উঠছে?”
“আজ তোমার কারণেই ওর বাবা কথা কথা শোনালো! এতো বছরের প্রেম আজ ভেংগে যাচ্ছে তোমার জন্যেই, কী হতো যদি নিজেকে একটু মানিয়ে নিতে?”

লেখক: ফাহমিদা খানম

স্তব্ধ হয়ে ভাবলাম –আমার এতো ত্যাগ সবই কি তুচ্ছ হয়ে গেলো? এবার মনে হয় আমি সত্যিই হেরেই গেলাম, কী বোকা আমি? অলৌকিকতায় বিশ্বাস করে এতোটি দিন পার করলাম? ভেবেছিলাম দুই সন্তান অন্তত যুক্তি দিয়ে মাকে বুঝবে। ওরাও পুরাতন পৃথিবীর চশমা পরেই মাকে দেখছে! ওদের কাছেও প্রিয়জন আর হতে পারলাম কই?

লজ্জার মাথা খেয়ে রিয়ার বাসায় ফোন দিলাম, একটু সময় ভিক্ষা চাইলাম – হ্যাঁ সন্তানের জন্যেই, মা যে! অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ধ্রুবর বিয়ে ঠিক করলাম — হ্যাঁ নিজেকে নত করতেই হয়েছে সন্তানের জন্যে। ছেলের মুখে হাসি দেখে মায়ের মন শান্তি পেলেও অনেককিছুই অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে!

জীবনের কিছু ক্ষেত্রে নারী –পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই সবাই অসহায় সময়ের কাছে, জীবন যখন রসিকতা করে বসে তখন অসহায়ত্বের মুখে বেশিরভাগ মানুষই নিজেকে ভোঁতা করে জীবনটা মুখ বুঁজে পার করে দিলেও অনেকেই কিন্তু পারে না সামাজিকতার ভারী পোশাক খুলে সাহসী হতে, কারণ পায়ের নিচের ভিত মজবুত না হলে এটা হয় না।

“প্রতি বছর আজাইরা বইয়ের পিছনে এতো টাকা কেন নষ্ট করো?”
“এই একটাই নেশা আমার, বই পড়া”
“আমাদের মা–খালাদের দেখেছি অবসরে কাঁথা সেলাতো, পিঠাপুলি বানাতো—তোমারে এসব করতে দেখি না”
“সবার যে সব গুণ থাকবে এমন কথা কি কোথাও লিখা আছে? একেক মানুষ একেক রকম”।

শুরুটা এভাবে হলেও আস্তে আস্তে ভুলের পরিমাণ বাড়তেই লাগলো, ততদিনে ধ্রুব পেটে এসেছে — সংসারের কাজে সাহায্য দূরে থাক গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ বেড়াতে এলে বউকে সবার সামনে তাচ্ছিল্য করার পরিমাণটা আরও বাড়তো!
চাকরি করে টাকা উপার্জন করে নিজেকে সে সেরাই ভেবেছে, মনে পড়ে তীব্র জ্বর নিয়ে করা রান্নার বাটি ছুঁড়েছিল রান্না ভালো হয়নি বলে, আমার প্রাক্তন স্বামী বাংলা সিনেমার বিশেষ ভক্ত ছিলেন – এক বিশেষ নায়িকার এতো কঠিন ভক্ত ছিলেন যে, নিজের স্ত্রীকে তেমনই আশা করতেন – যে নায়িকার কাজই ছিলো স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির জন্যে নিজেকে উজাড় করে রাখা!

আজো ভেবে পাই না মেয়েদের এতো আত্মসম্মানহীন কী করে দেখাতো সিনেমায়? মানুষ বলেই গণ্য করতো না, ধ্রুবর জন্মের পরে আশা করেছিলাম পরিবর্তন কিছুটা আসবে, নাহ আসেনি। মাঝখান দিয়ে আমি আবারও মা হলাম — দুজন মানুষের মাঝে শারীরিক, মানসিক –কোনো সম্পর্কই আর ছিলো না।

পাঁচ বছরের সংসার জীবনে দুই বাচ্চা, সংসার সব মিলিয়ে আমি ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে গেলাম – মানসিক রোগ ধরা পড়লো। স্বামী, শ্বশুরালয় তাবিজ -কবচ করে ব্যর্থ হয়ে আমাকে বাপের বাড়িতে ফেলে রেখে সবাইকে কঠিন কথা শোনালো — তারা নাকি না জানিয়ে পাগল মেয়ে গছিয়ে দিয়েছে, মা প্রতিবাদ করলেন, জানালেন, তার সুস্থ মেয়ে বিয়ের পর সংসারে গিয়েই অসুস্থ হইছে, ব্যস তারা রেগে আগুন হয়ে আর খবর রাখেনি।

আমার মা-বাবা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বার বার অপমানিত হয়েছেন আর স্বামী শেষে যখন শর্তই দিলো সংসারে ফিরতে হলে তার পছন্দমতো চলতে হবে— আমিই বেঁকে বসলাম—বিয়ে, সংসার শর্ত দিয়ে বয়ে চলার জিনিস না! বুঝলাম স্বামী আর আমাকে নিয়ে সংসার করতে আগ্রহী না, এক বছর পরে শুনেছিলাম গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করে খুব সুখেই আছে আমার প্রাক্তন স্বামী –সেটাই তো স্বাভাবিকতা!
যে যেই পরিবেশে বড়ো হয় আজীবন সেটাই বুকে পুষে রাখে, শিক্ষা তার অবস্থার পরিবর্তন করলেও মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারে না।

“মা আমার ভিসা হয়ে গেছে, ভাইয়ার বিয়ের পরেই আমি মালয়েশিয়া চলে যাবো”
“অভিনন্দন রুদ্র, ভাইয়ের বিয়েতে কী করতে চাও লিস্ট করেছো?”
“তুমি কোন জগতে আছো মা? বিয়ের সব প্রোগ্রাম ও বাড়ির পছন্দেই হচ্ছে, আমাদের পছন্দের কথা আসছে কোত্থেকে? তোমার বড়ো পুত্র অলরেডি গৃহপালিত হয়ে গেছে, তোমাকে বুঝতে হবে”
“ভালই হইছে রুদ্র, শক্ত খুঁটি হয়েছে ধ্রুবর, তুমিও নিজের পছন্দে বিয়ে করো, তারপর আমার ছুটি”
“আমি তো বিয়েই করবো না, এসব ঝামেলা লাগে – আজীবন স্বাধীন থাকতে চাই আমি”।

দুপক্ষের সম্মিলিত বিয়ের প্রোগ্রাম হলেও আমি ছিলাম অতিথি হয়েই, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সেন্টার সাজানো সবকিছুই ধ্রুব শ্বশুরবাড়ির সাথে পরামর্শ করে করেছে, আমাকে কোথাও রাখার প্রয়োজন মনে করেনি, বিয়ের আসরে বেয়াই–বেয়াইন শুধু কয়েকজনকে পরিচয় দিয়েছিলেন —জামাইয়ের মা হিসাবে!

বিয়ের পরেই রুদ্র চলে গেলো মালয়শিয়া – যাবার আগে কতো সুন্দর করেই না শোনালো – একটু দাঁড়ালে মাকেও কাছে নিয়ে যাবে! তার কয়েকদিন পর একদিন দেখি ছেলে, বউ সুটকেস নিয়ে বেরুচ্ছে – বললো, হানিমুনে যাচ্ছে –কোথায় যাচ্ছে, কবে ফিরবে, বলার দরকার মনে করেনি, যখন মাকে দরকার ছিলো তখন সব জানাতো, এখন দরকার মনে করে না!

একাকিত্ব কতো ভয়ংকর টের পেলাম – কিছুদিন আগেও দায়িত্বের চাপে দিশেহারা ছিলাম! স্কুলের চাকুরী, বাসার কাজ নিয়ে কতো ব্যস্ততা ছিল! হানিমুন থেকে ফেরার পরেও অবস্থার পরিবর্তন হলো না, সকালে ধ্রুব অফিস যাবার সময় বউ সাথে বেরিয়ে যায় বাপের বাড়িতে, সন্ধ্যায় দুজনেই খেয়ে ফিরে, রাতটা শুধু বাসায় ঘুমাতো। বিয়ের পরে বউয়ের বাবা ফার্নিচার দেবার পরে পুরানো ফার্নিচারগুলো আমার রুমে স্তুপ করেই রাখলো — দুই পুরাতন জিনিস একই রুমে! নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছিলো, পুরানো ফার্নিচারের মতো আমিও বাতিলের দলেই!

“ধ্রুব, রুদ্রটা যে এমন একটা কাজ করে বসবে আমি ভাবিনি”
“যার যার জীবন মা, তোমার ভাবাভাবির কী মূল্য সেখানে? রুদ্র যদি চাইনিজ মেয়ে বিয়ে করে সুখী হয়, আমার কোনো সমস্যা নেই”।

ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলাম — ভালবাসা দূরে থাক, করুণা ছাড়া কিছুই নেই আর!
দুইদিন নিজের সাথে বোঝাপড়া করে সেদিন সকালে ওরা বেরিয়ে যাবার পরে নিজেও বের হলাম –সকল দায়িত্ব শেষ করেছি, এবার আমারও ছুটি হলো!

জীবিত অবস্থায় এদেশের খুব কম মানুষের ভাগ্যেই নাকি সম্মান জুটে – আমিও একজন ভাগ্যবতী বটে! যাদের জন্যে ত্যাগ করলাম, তাদের কাছে প্রয়োজন হয়ে ছিলাম – আর কিছু নয়। ওদের নতুন জগত হয়েছে, সেখানে মা না হলেও চলে যাবে। কারো করুণায় বাঁচতে চাই না বলেই সসম্মানে বৃদ্ধাশ্রমেই রওয়ানা দিলাম।

করুণায়, অবহেলায় আমার আজীবনের অভক্তি।

১৯/৪/১৯

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.