নুসরাত হত্যা: রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কদর্যতার উদাহরণ!

দিলশানা পারুল:

নুসরাত হত্যা ঘটনা বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর কদর্যতা বোঝার জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা এবং তার পরবর্তীতে তাকে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পুড়িয়ে মারা, প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের পরতে পরতে সংশ্লিষ্ট থাকার যে ঘটনাগুলো বের হয়ে আসছে, সেইটা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামো নারী নিযার্তন এবং ধর্ষণকে কীভাবে প্রমোট করছে তার একটা ভয়াবহ এবং জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।

পত্রিকা মারফত এর মধ্যেই আমরা জেনেছি ঘটনার শুরু ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে না। ঘটনার শুরু আরো দুই বছর আগে। নুসরাতকে প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার চোখে চুন ছুঁড়ে মারা হয়েছিল, সেই ঘটনায় নুসরাত হাসপাতালে ভর্তি ছিলো বেশ কিছুদিন। এরপর তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা এবং তাকে পরিকল্পনা করে পুড়িয়ে মারা। এই যে নুরউদ্দিন এবং শামীম যাদের নামগুলো উঠে আসছে তাদের স্থানীয় বখাটে বলে আসলে ছোট করা ঠিক না। বাজি ধরে বলতে পারি শুধু নুসরাত না, এদের লালসার শিকার এই এলাকার আরো অসংখ্য মেয়ে।

দিলশানা পারুল

পত্রিকা বলছে, তাদের ধারণা ছিলো তারা নুসরাতের সাথে ঘটে যাওয়া আগের ঘটনাগুলো যেভাবে সামাল দিয়েছে, হত্যাকাণ্ডও একইভাবে সামাল দিয়ে দিতে পারবে। ইনফ্যাক্ট সামাল দিয়েও দিয়েছিলো।

১৭ এপ্রিল মাহমুদুল হাসান আরিফ নামের একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন –
“রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর একে আত্মহত্যা বলে প্রচারের বিষয়টি সমন্বয় করেন ওসি মোয়াজ্জেম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন। সহযোগিতা করেন কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম। এ কাজে দায়িত্ব দেওয়া স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। তাঁদের দায়িত্ব ছিল নিজ নিজ গণমাধ্যমে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজ নিজ আইডি থেকে অপপ্রচার চালানো। তাঁদের মধ্যে তিনজন জাতীয় দৈনিকের উপজেলা সংবাদদাতা ও অন্য তিনজন স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী। ঘটনার কিছুক্ষণ নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেন দৈনিক ‘সমকাল’-এর উপজেলা সংবাদদাতা আবুল হোসেন রিপন। রিপন লেখেন, ‘সোনাগাজীতে শরীরে পেট্রল ঢেলে ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা।”

বিষয়টা শুধু যে সাংবাদিকদের ৫০, ৬০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে মিথ্যে রিপোর্ট এর জন্য এতোটুকুই না। সোনাগাজী থানার ওসি তার ধারণকৃত ভিডিও ভাইরাল করে নুসরাতের দায়ের করা মামলা যে সত্য ছিলো না সেইটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। স্থানীয় থানার ওসি এই দুই বছর যাবত কথিত বখাটেদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উপরন্তু ম্যাজিস্ট্রেট মামলা দিতে বললে সেই মামলাও করেননি।

প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট জনাব সোহেল তার ফেসবুক প্রোফাইলে এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পত্রিকার নিউজে দেখলাম, সেই ওসিকে রক্ষা করার জন্য খোদ ডিআইজি আবার উপরের মহলে সুপারিশ করেছেন। যেই স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দুই বছর ধরে এই সমস্ত অন্যায় নিশ্চিন্তে হতে দিয়েছে, কোন ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, বরং নুরুদ্দিন, শামীম এই সমস্ত স্থানীয় মাস্তানদের হাতে রাখার জন্য সব ধরনের ওয়াকওভার দিয়ে রেখেছিলো, সেই পুলিশ প্রশাসনকে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী তদন্ত করে বলছে, পুলিশের গাফিলতি ছিলো।

সিরিয়াসলি, পুলিশের দ্বারা সংঘটিত একটা ক্রিমিনাল এক্টকে আপনারা শুধু গাফিলতি বলে ওয়াকওভার দিয়ে দিতে চাচ্ছেন? একটা মেয়ের উপর প্রথমে যৌন নির্যাতন করা হবে, তারপর সে যেন প্রতিবাদ না করে সে ব্যবস্থা করা হবে, যদিও বা ঘটনাক্রমে সে প্রতিবাদ করে তবে তাকে মেরে ফেলা হবে এবং মেরে ফেলে সেই ঘটনা আবার সামালও দিয়ে দেয়া হবে।

নুরুদ্দিন বা শামীমদের পালেন এবং পোষেন আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনরা। আর রুহুল আমিনদের সকল অপরাধের প্রটেকশন দেয় আমাদের সম্মানিত ওসি সাহেবেরা। কেন? কারণ হিসাবটা খুব সহজ, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। আমার অন্যায় তুমি ঢাকবা, তোমার অন্যায় আমি।

এই অপরাধী সিন্ডিকেটের মধ্যে ক্ষমতার কাছাকাছি কে নাই? মাদক ব্যবসায়ী, এলাকার সরকারি দলের সভাপতি, এলাকার পুলিশ প্রধান, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, স্থানীয় সাংবাদিক এবং পারাত মাস্তান এই যদি হয় একটি এলাকার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মডেল, তাহলে বাংলাদেশে প্রত্যেকটা এলাকায় প্রতিদিন গণ্ডায় গণ্ডায় নুসরাতদের বলি হওয়ার কথা। আমরা বরং শুকুর করি যে প্রতিদিন এক ডজন করে নুসরাতরা হত্যা হচ্ছে না। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন রিপোর্ট দিয়েছে গত ১৫ দিনে ৩৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাং রেইপও আছে।

যেই দেশে আঞ্চলিক পর্যায়ে এই রকম অর্গানাইজড অপরাধী সিন্ডিকেট থাকে এবং যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সরকার সেই সিন্ডিকেটকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে, সেই দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ হবে না, এইটা ভাবাও তো অন্যায়!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.