কোন ধর্মটি মানবধর্ম?

সারা নুর:

বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতাপশালীরা বরাবর বলে এসেছেন, যেই লোক ধর্ম বিশ্বাস করে না, তার চরিত্র, কর্মকাণ্ড সব খারাপ। নাস্তিক মানেই দুশ্চরিত্র। মুক্তমনা প্রত্যেক লেখক মুরতাদ এবং পাপী। পর্দা না মানা নারীরা নিজের দোষে পর্দা না মানার কারণেই ধর্ষণের শিকার হোন…ইত্যাদি ইত্যাদি!

এইসব চিন্তাধার ছড়িয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি দিয়ে মানুষকে অন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে দেয়া হয়েছে অপবাদ ।

ধর্ম ব্যবসায়ীরাই তো সমাজে কোনো অপরাধ ঘটলে বলে এসেছেন ধর্ম মানলে নাকি এইরকম অপরাধ ঘটতো না, পর্দা করে চললে ধর্ষন বন্ধ হয়ে যেতো! সব অপরাধ আর পাপ কাজের মহৌষধ হিসেবে ধর্মকে তারা উপস্থাপন করেছেন।

ছবিটা ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

আজকে তাদেরই একজন ধর্মকর্ম মানা অবতার, সম্মানিত অধ্যক্ষ সাহেব যখন ধর্ষণের চেষ্টা করেছে, যৌন হয়রানি করেছে, তখন কেনো তাকে শুধু ধর্ষক বা নিপীড়ক বলা হবে? কেনো প্রশ্ন আসবে না যে, ধর্মকে ব্যবহার করে কর্তৃত্ব করে আসা ব্যক্তিটি নিজেই কেনো ধর্ম মানলেন না? একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি ধর্ম না মানেন, তাহলে তিনি এতোদিন কী শিখিয়ে এসেছেন?

প্রশ্ন তো আসবেই, আপনাদের বর্ণনা মতো ধর্ম না মানার কারণেই যদি সব অপরাধ হয়ে এসেছে, তাহলে এইসব ধর্মভীরু লোকেরা কেনো অপরাধ করছে?

আপনারা তাহলে যেই ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দিতে আসেন তা আপনারা নিজেরা মানেন না?
জানতে চাওয়া হবেই, যেই সৃষ্টিকর্তার ভয় আপনারা মানুষকে দেখান, সেই সৃষ্টিকর্তাকে আপনারা নিজেরা ভয় পান না কেনো?

এই চলমান হিপোক্রেসির চর্চাকারী, বাংলাদেশের বর্তমান হুজুর সমাজ কিন্তু এখন পর্যন্ত নুসরাত জাহান রাফির খুনের শাস্তির দাবীতে কোনোরকম কর্মকান্ডে যোগ দেয়নি। কোনো মাদরাসার শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করার জন্য রাস্তায় নামেনি।

প্রতিবাদ করছে কারা? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা, যাদের কিনা ধর্মের দোহাই নিয়ে নানান অপবাদ অহরহ দেয়া হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর জন্য পথে নামার নজির না থাকলেও, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর ন্যায়বিচারের আশায় বহু ধর্ম না বিশ্বাস করা ছেলেমেয়ে প্রতিবাদে নেমেছে।

প্রতিবাদ করছেন নারীবাদী, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বহু মানুষ যারা হয়তো ধর্ম পালন করেন না। পর্দা প্রথায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু পর্দানশিন মেয়েটির জন্য তাঁরা ন্যায়বিচার চায়।

ইসলামধর্ম অনুসরণকারী বোরখাপরা একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিবাদে নেমেছেন অন্য ধর্মাবলম্বী বহু মানুষেরা…

কারণ তাঁরা প্রত্যেকে মানবতাবাদী, ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভেদকারী নয়।

ধর্ম ব্যবহার করে বিভেদ তৈরি করতে চেয়েছে একটি বিশেষ শ্রেণী, যারা কিনা মুক্তমনা ব্লগার/লেখক খুন হলে প্রতিবাদ করেননি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারো উপর অত্যাচারে প্রতিবাদ করেনি, প্রতিবাদ করেনি কোনো যৌন নিপীড়নের ঘটনায়। তাদের কাছে মানুষের উর্দ্ধে ধর্ম।

ধর্ম পালন করে এমন কোনো লোকই এই ঘটনায় প্রতিবাদ করছে না, বা ধর্ম পালনকারী প্রত্যেকেই খারাপ, এটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য আপনাদের বলা যে ধর্ম না মানলেও মানুষ ভালো হতে পারে। অন্য ধর্মের মানুষেরাও ভালো হতে পারে। ভালো মানুষ হওয়ার পূর্বশর্ত অবশ্যই ধর্মপালন নয়। ‘শার্ট প্যান্ট পরা/দাড়ি না রাখা ছেলেটি কোনো হুজুরের চেয়ে খারাপ নয়, শাড়ি টিপ পরা মেয়েটি কোনো বোরখাপরা মেয়ের চেয়ে খারাপ নয় এটি মানতে শিখুন।

ধর্মে বিশ্বাস না থাকা মানেই কেউ অপরাধী নয়, আর ধর্ম বিশ্বাসী প্রত্যেকেই সাধু বিশেষ নয়। ধর্মকে কেন্দ্র করে এই যে বিভেদ সৃষ্টি করা, নিজে যেই ধর্ম পালন করি সেই ধর্মে যদি কেউ বিশ্বাস না করে বা সে যদি অন্য কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ পালন করে তাহলেই সে খারাপ, আর দাড়ি টুপি আছে, বোরখা পরে, প্রবলভাবে ধর্ম পালন করলেই সে ভালো এই যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি, এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে।

নতুন বছর শুরু হতে যাচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা থাকবে, “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”।

শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: