কেন কাঁদছেন নুসরাতের জন্য, বলবেন?

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

নুসরাতের মৃত্যুর জন্য আমার হৃদয়ে একফোঁটাও হাহাকার নেই; একবিন্দু কষ্টও পাইনি আমি! আমি মনে করি, ও মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। যে সমাজে গা ঘেঁষে না দাঁড়াতে বলায় আপনারা মেয়েদের গায়ে কলংকের কালিমা লেপে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি, তাঁদের চরিত্র হননের সকল বিহিত ব্যবস্থা করেছেন আন্তরিক নিরলস প্রচেষ্টায়, সেই সমাজে নুসরাতের জন্য হঠাৎ আপনাদের এই মায়াকান্নাটা আমি ঠিক নিতে পারছি না।

যারা ওর জন্য মায়াকান্না কাঁদছেন, কেন কাঁদছেন বলবেন? ও বেঁচে থাকলে কী হতো? ওকে সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে আপনি আমি কী কী করতাম? রাষ্ট্র, সমাজ প্রশাসন কী কী বাড়তি সুবিধে দিত বলে আপনার মনে হয়? যাতে করে ও মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বাঁচতে পারতো!

হ্যাঁ, ও প্রতিবাদী ছিল, ওর প্রতি করা দাঁতাল শুয়োরদের রিরংসাকে ও মুখ বুঁজে বোবা কান্নায় মেনে নেয়নি। কিন্তু এই সমাজে বাঁচতে গেলে এটাই তো শেষ কথা নয়! প্রতিবাদী হলে তো তাঁকে আরও মার খেতে হয়। কারণ, সে যে মেয়ে! মেয়ে তো মানুষ নয়! ঊনমানুষ! কিংবা অর্ধ মানুষ!

আমাদের রাষ্ট্র, প্রশাসন, সমাজ ও অশরীরি ধর্মের দণ্ড কি নুসরাতের আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী নয়? আর এই সমাজ বলতে কি আমি-আপনি ও আমরা নই? খুব বড় গলা করে আজ কথা বলছি আমরা, কিন্তু এক একটা ধর্ষণের ভয়াবহ বীভৎস ঘটনাগুলো যখন ঘটে, তখন কি এই সমাজের আপনি আমিই মেয়েটির অপরাধের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে নেমে যাই না? আমরাই কি ধর্ষণের জন্য প্রতিবার প্রতিটি মেয়েকে দায়ী করি না? তাঁদের পোশাক আশাক, চলাফেরা, মতিগতি, প্রেমের সম্পর্ক; ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে এই ধর্ষণটিকে জায়েজ বলে প্রমাণে লিপ্ত হই না?

আজকের বাংলাদেশে এমন নুসরাতের সংখ্যা এটিই কি শেষ? নাকি এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে? কোনটিকে আপনি খুব সহজভাবে, যুক্তিসঙ্গতভাবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে অপরাধ নয়, জঘণ্য ঘৃণ্য পাশবিক কাজ নয় বলে মনে করেন? আজকে চেঁচামেচি হচ্ছে, দুদিন পরে আবার এর থেকে ভয়াবহ কিছু ঘটবে আমরাও কেঁদে কেটে আকূল হয়ে বুক ভাসাবো। অতঃপর টিভির রিমোট হাতে জি বাংলা দেখবো, কিংবা বিশ্বকাপে, এশিয়া কাপে আমাদের সোনা জেতা কিংবা আমাদের স্যাটেলাইট প্রক্ষেপণ অথবা ডিজিটাল বাংলাদেশের গর্বিত খবরের পাতায় উজ্জ্বল মুখ লুকাবো!

আমরা তো উটপাখি; আমরা বালিতে মুখ গুঁজে চলি, আমাদের ইস্যুর বয়স টিস্যুর মতোই, টিস্যুর জীবনকালের সাথে সাথেই আমাদের আবেগ দলিত মথিত হয়ে চলে যায় ডাস্টবিনে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না একটা থেকে আরেকটা ইস্যু পেতে। আপাতত কান্নাকাটি বাদ দিন, দিয়ে ভাবুন আজকের এই সিরাজ আপনার আমার ঘরে ঘরেই বাস করে। ভিনগ্রহ থেকে আসেনি। আমরাই প্রকারান্তরে মদদ দিয়ে ওদের লালসাকে তেলে জলে বাড়িয়ে দিয়েছি।

সুতরাং অযথা কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ না করে যদি পারেন এবার রাস্তায় নামুন। একাট্টা হোন,সমস্বরে চিৎকার দিন! জিজ্ঞেস করুন, প্রশ্ন করুন, রাষ্ট্রকে, সমাজকে, প্রশাসনকে; আর কত? আর কত কত লক্ষ তনু, খাদিজা, নুসরাত মরলে মানবে তুমি শেষে?

এই শুয়োরদের বিচার কি হবে এই দেশে? মেয়েরা কি মানুষের পরিচয় পাবে এই ডিজিটাল বাংলাদেশে? প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করতে শিখুন! মেয়ে আপনারও আছে, কথাটা ভুলে যাবেন না!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.