নুসরাতের জ্বালানো আগুনে খাক হয়ে যাক সব

সুপ্রীতি ধর:

ডায়িং ডিক্লেয়ারেশন দেয়া নুসরাত জাহান রাফির কথাগুলো শুনে থ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। শরীরের ৮০ শতাংশ যার পুড়ে যায়, যার মৃত্যু থাকে অবধারিত, সে কতোটা মনের জোরে এই কথা বলতে পারে?

আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম একটিবার। সেই সুযোগ দেয়নি পোড়ামুখী মেয়েটা। তাই আজ আমি তার কাছ থেকে সাহস ধার করে তার বিরুদ্ধে করা অন্যায়সহ সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাই, বলতে চাই, “যে যেখানে আছো, সবাই আজ এক হও, প্রতিবাদ করো”। সে বলেছে, “আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাবো, আমার জীবন থাকতে যে অন্যায় প্রিন্সিপাল আমার সাথে করেছে, সে অন্যায়ের সাথে আপোষ করবো না…”।  ছোট্ট মেয়েটা আগুনে ঝলসে গিয়েও অপরাধীর বিচার চেয়ে গেছে, আমরা যারা এখনও সুস্থ আছি, আমাদের কি দায়িত্ব না ওর এই দাবিটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া?

আহারে মেয়েটা, আহা নারী জীবন! মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এতো স্পর্ধা, এতো সাহস তুই পেলি কোথায়? তোর এই বয়সে আমার তো অতো সাহস ছিল না! কিন্তু এইটুকু জানি, তোর এই সাহসকেই ভয় করে পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত অন্যায়, দুর্নীতি, অসততা সকলেই মানুষের এই শক্তিকে ভয় করে। নারীর হলে তো কথাই নেই। তাইতো এই সাহসের মুখটাই ওরা বন্ধ করে দিতে উদ্যত প্রতিনিয়ত। যে নারীর শিরদাঁড়া যতো ঋজু, যে নারীর কণ্ঠ যতো সচকিত, সেই নারীকেই থামিয়ে দিতে দলমত নির্বিশেষে সব একাট্টা। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হেফাজত, জামায়াত, বাম, ডান, প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল সব একাকার! নারীর উচ্চকণ্ঠ ধারণ করতে হেডম লাগে, হেডম। সবাই নিতে পারে না।

নুসরাতের কথা শুনে আমার রক্ত টগবগ করছে গত কদিন ধরে, একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম যেন। মনে মনে আমি আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। সামনে যত বাধাই আসুক, তা উপড়ে যেতে পারবো, সেই সাহস আজ আমার আছে। সহযোদ্ধাদের তাই বলছিলাম কী, এখন আর দলাদলি করো না কেউ, একা একা লড়াই করা যায় ঠিকই, কিন্তু ফল আসে না। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি এই লড়াইয়ে একা দৃঢ় থাকা শেষপর্যন্ত সম্ভব হয় না।

আজ নুসরাত চলে গেল। অনেকে আফসোস করলেও আমি মোটেও তা করছি না। কারণ ওর বেঁচে থাকাটাই হতো নির্মম, ভয়ংকর। এই সমাজে সুস্থ, স্বাভাবিক কোনো মেয়ের পক্ষেই আর স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে নুসরাত কীভাবে বাঁচতো? আমি তাকে কোনদিনই সেই নির্মমতা নিয়ে বসবাস করতে বলতে পারি না। তাই চেয়েছি যতো সহজে ওর যন্ত্রণার উপশম হয়, ততোই ভালো।

ওর চলে যাবার খবরে বারবারই মনে হচ্ছে, ও চলে গেলেও একটা নিশ্চিত আগুন সে জ্বালিয়ে গেছে, আর সেই আগুনটার ব্যবহারের এটাই সুযোগ্য সময়। তার চেয়েও ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজকে ভেঙে গড়ে তুলতে এই মুহূর্তে দেশে একটা যুদ্ধ প্রয়োজন, নারীদের রক্ষায় নারীদেরই এই যুদ্ধটা করতে হবে, লড়াইয়ে শামিল হতে হবে।

মেয়েদের বলছি, তোমরা কেউ কথা বলা বন্ধ করবে না। এক তিল পরিমাণও আর স্পেস দেয়া যাবে না জঘন্য ওই নরপিশাচগুলোকে। এমনকি পুরুষতন্ত্রে শামিল ওই নারীদেরও চিহ্নিত করা সময়ের দাবি এখন, যারা পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
কথা বলে যেতে হবে। গালি দিলে দিবে, এতোদিনে তো আমাদের চামড়া গণ্ডারের হয়ে যাবার কথা। কাজেই গালি খেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। গালি মানেই তো আমাদের দমিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র, তো আমরা সেটা হতে দেবো কেন? বলুক আমাদের খানকি, মাগী, বেশ্যা। নতুন কিছু না। আমাদের নামের সাথে এসব বিশেষণের বদলে যদি পাঁচটা মেয়েও রক্ষা পায়, তাহলেই আমাদের জীবন ধন্য। আমাদের এতোদিনের পরিশ্রম সফল। আজ দলে দলে বেরিয়ে আসতে হবে মেয়েদের। যে যেখানে যে কাপড়েই আছো, বোরকা বা হিজাব, বা প্যান্ট-ফতুয়া, শাড়ি-সালোয়ার কামিজ, কোনটাই মুখ্য নয়। নারীর বেরিয়ে আসাটাই মুখ্য। ওরা তখন ভয় পাবে, ভীষণ ভয়। এটাই সমাধান আনবে।

যারা এই কদিন ধরে অনলাইন তোলপাড় করছে এক টিশার্টের ভাষা নিয়ে, নোংরামিতে যারা নর্দমার কীটকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজলো বলে। ওইসব খিস্তিখেউড় করে বেশিদূর তারা এগোতে পারবে না বলে দিচ্ছি। আমি সেই আওয়াজটাই যেন শুনতে পাচ্ছি, দলে দলে পায়ে পা মিলিয়ে মেয়েদের বেরিয়ে আসার আওয়াজ। আহা!

মাদ্রাসার সেই অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার মুক্তি চেয়ে মিছিলের ছবিটা দেখলাম, সেই মিছিলে যেসব বোরকা, হিজাবে আবৃত মেয়েদের দেখলাম, প্রথম দেখায় কিছুটা রাগ হলেও বুঝেছি, ওরা ধর্মের আফিম খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে। ওদেরকে মুক্ত করাও একটা কাজ। আর এই শয়তান, নরপিশাচ অধ্যক্ষ বুঝি এই শিক্ষাই পেয়েছে ধর্ম পড়িয়ে এবং নিজে পড়ে? মাদ্রাসার ছাত্র এবং ছাত্রী উভয়েই তো এইসব হুজুরদের কাম-লালসার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মুখে মুখে শান্তির ধর্ম বলে ফেনা তোলে আর কাজেকর্মে বিশ্বজুড়ে কেবলই অশান্তি ছড়াচ্ছে। নিজেদের মুর্খতার কারণেই আজ কোন অধ:পতন যে ডেকে এনেছে নিজেরাই, খেয়াল করেছেন কেউ একবারও? এদেরকে রুখে দিতে হবে অচিরেই। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই।

প্রশ্ন জাগে, নিজেরাই ফটোশপ করে যখন নিজেদের নবীর নামে বাজে বাজে কথা লিখে কিছু লোক, তখন এদের হাত কাঁপে না? আমি তো পারবো না, আমি সেই শিক্ষা পাইওনি। নিরীহ সংখ্যালঘুদের তাড়ানোর জন্য কতো কীই না করছে ওরা! আর প্রশাসনের মদদ তো আছেই! সেদিন দেখলাম নড়াইলে জনৈক সংখ্যালঘুর ফাঁসির দাবিতে হাজার হাজার মানুষ এক হয়ে গেছে। এক বানোয়াট কাহিনী দিয়ে দিনের পর দিন জায়গাজমি দখলের এই ব্যবসা চালাচ্ছে ওই দুষ্টচক্র। রাষ্ট্র যাদের পিছনে, আর আমাদের দুর্ভাগ্য।

নারী আর সংখ্যালঘুর ভাগ্য মূলত একই। অথচ এই ধর্মেরই বেঁধে দেয়া পোশাক পরা মেয়ে নুসরাত, যে ধর্মশিক্ষা নিতে গিয়েছিল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেই তাকে ধর্ষণ করতে না পেরে রাগে-ক্ষোভে যখন আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চালালো সেই ধর্ম শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে, সিকিভাগও তো নামলো না রাস্তায়! কেন? নুসরাত মেয়ে বলে? কিছুদিন আগেই চকবাজার, বনানীতে আগুনে পুড়ে মারা গেল কতোগুলো মানুষ। তখন দেখেছি ওদের জন্য অন্যদের হাহাকার। অথচ নুসরাত যখন দগ্ধ হয়, তখন কেবল একজন নারীই দগ্ধ হয়, তার জন্য হা-হুতাশও বরাদ্দ নেই খুব একটা। নারীর আবার জীবন কী, তাই না? বাঁচলেই কী, মরলেই কী!

বিশিষ্ট জালেম আলেমদের বলছি, আপনাদের ধর্মই তো মানতো নুসরাত, তাহলে তার জন্য আপনাদের প্রাণ কেন কাঁদলো না একটিবারও? যাকে দেখেননি, সেই নবীর জন্য কাঁদেন, অথচ রক্ত মাংসে গড়া মানুষের জন্য আপনাদের প্রাণ পুড়ে না। এ কেমন মানুষ আপনারা? ছি:।

অজন্তা দেবরায় ঠিকই লিখেছে, “ফেইসবুকে কেউ পান থেকে চুন খসার মতো কিছু লিখলো কিনা সেটা নিয়ে ‘ধর্ম অবমাননা হয়ে গেলো‘ ‘ধর্ম গেলো‘ ‘ধর্ম গেলো‘ রব তুলে আলেম ওলামাসহ হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে যান। এখন যখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মূলত ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে একের পর এক বীভৎস ধর্ষণ, খুনের মত ঘটনার খবর আসছে, তখন কি সেই সব মানুষদের অনুভূতিতে লাগছে না? ধর্মের বেশধারী অধর্মকারীরাই কি ‘ধর্মে’র সবচে বড় অবমাননা করছে না?

প্রায়ই দেখি ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একদল মুমিন ওলামা লীগের ব্যানারে আমাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তারা আমাদের ফাঁসির দাবি জানায়। কী আমাদের অপরাধ? অপরাধ একটাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, মানবতার পক্ষে, নারীর প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ি। আর হ্যাঁ, নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার থাকি। তাতেই তাদের দণ্ডে আঘাত লাগে, আর এসে ছাগলের মতোন দাঁড়িয়ে যায় মানববন্ধনে। অথচ কোনদিন দেখেছেন কেউ দেশের কোনো ন্যায্য দাবি নিয়ে এরা রাস্তায় আছে? অথচ ধর্মের ভালো লেবাসই তারা পরে আছে।

তাই বলছিলাম কী, আজ যখন নুসরাত মারা যাওয়ার আগে স্পষ্ট করে অপরাধীর নামধাম সব বলে গেল, তখন এই সব খুনি-ধর্ষক মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশেই একটা আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে। ঈমানদার একেকজন! কষে লাত্থি দিয়ে সবগুলোকে সাগরে ফেলা উচিত। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।

জেনে রাখুন পুরুষতন্ত্র আর ধর্মের ধ্বজাধারী ও ঝাণ্ডাধারীরা, যে আগুন নুসরাত জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেই আগুনে আপনারা নিজেরাই পুড়বেন, ওয়েন্ট এন্ড সি!

আরেকটা কথা বলি। সোনাগাজী কতোদূর ঢাকা থেকে বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে? সবাই মিলে যান ওখানে, একটা আন্দোলন গড়ে তুলুন ওই অধ্যক্ষসহ সবগুলো বদমায়েশের বিরুদ্ধে। একটা শিক্ষা হোক সারাদেশের জন্য। যে আগুন জ্বালিয়ে গেছে নুসরাত, তাতে পুড়ে খাক হয়ে যাক অসভ্য এই সমাজ। ভেঙেচুরে যদি গড়ে উঠে নতুন কিছু, তাই টিকে থাকবে, নয়তো নয়।

আগুনটা জ্বলে উঠুক ওখান থেকেই। নুসরাত বিচার চেয়ে গেছে, এখন আমাদের সবার দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা। একটা ছোট্ট মেয়ে নুসরাত, অথচ কী প্রাণশক্তি তার! ভেবে দেখেছেন? প্লিজ কিছু একটা করুন। ওইসব মাদ্রাসা নামের যৌন হয়রানি আর ধর্ষণের আখড়াগুলোকে শয়তানমুক্ত করুন। নতুন বছরে এই কাজটাই না হয় করুন আপনারা।

সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.