সুমিত রায়:
“গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না” টিশার্ট নিয়ে এদেশের মানুষের এতো ট্রোলিং, বাজে বাজে কমেন্ট এগুলোকে আমি শুধু একটা ফেনোমেনা দিয়েই ব্যাখ্যা করি, “ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স”! বাংলা করলে “সতী-বেশ্যা জটিলতা” হতে পারে।
ফ্রয়েড একটা মানসিক সমস্যাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই টার্মটা আবিষ্কার করেছিল, আমি সেই অর্থে এই টার্মটাকে ব্যাখ্যা করি না, এরপর নারীবাদী তাত্ত্বিক নাওমি ওলফ সেক্সুয়াল পলিটিক্স ব্যাখ্যা করার সময় সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভার্জিন-হোর স্প্লিট এর কথা বলেছিলেন, আমি সেই ব্যাখ্যা করতেও এই টার্মটা ব্যবহার করি না। তবে উপরের দুটো কেস থেকেই আমি সাহায্য নিয়েছি।
আসল কথায় আসি। আমাদের দেশের পুরুষের মধ্যে এই “সতী-বেশ্যা জটিলতা” এর স্বরূপ হচ্ছে, এরা হয় একজন নারীকে সতী-সাধ্বী ও খুব পবিত্র হিসেবে কল্পনা করে, আর না হয় কল্পনা করে হোর বা বেশ্যা হিসেবে। আর পুরুষের এই দুই রকম কল্পনাই শেষপর্যন্ত নারীর জন্য ক্ষতিকর হয় (নাওমি ওলফও তাই বলেছেন)।
“গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না” টিশার্ট আন্দোলন নিয়ে ছেলেদের গালাগালি করা বা ট্রোলিং করার কারণ অন্য কিছু ছিল না বলতে গেলে, তাদের মূল সমস্যা ছিল কেবল মেয়েদের টিশার্ট পরা, ওড়না না পরা এসব নিয়ে। মেয়েরা একটা টিশার্ট পরে, বাসে উঠে এরকম প্রতিবাদ করছে, তাদের গায়ে ওড়না নেই, এগুলো থেকে তারা একটা মেসেজই পেয়েছে যে, এই মেয়েগুলো হোর বা বেশ্যা, এদেরকে ইচ্ছামতো গালাগালি করা যায়, এদের সাথে এভাবে ট্রোল করা ও গালাগালি দেয়াই উচিৎ। এরকম পোশাক পরা দেখলে এরা হোর বা বেশ্যা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।
অন্যদিকে এরা যদি হিজাব-বোরখা পরতো, পর্দা ব্যবহার করতো, তাহলে এদেরকে এরা ভালো চোখে দেখে, আর যারা তা পরে না তাদেরকে বলে এরকম হিজাবি হয়ে “পবিত্র” নারীর মতো আচরণ করতে!
কথা হলো, আমাদের দেশের ছেলেদের মধ্যে এই ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স এতো বেশি কেন? এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? উত্তর খুব সিম্পল, এই দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতা। ছোটবেলা থেকে এরা বড়দের থেকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শেখে “ভালো মেয়েরা” কেমন আচরণ করে ও কেমন পোশাক পরে, আর “খারাপ মেয়েরা” কেমন আচরণ করে, কেমন পোশাক পরে।
তার উপরে আমাদের মিডিয়াগুলো এখন “ভালো মেয়ে” আর “খারাপ মেয়েকে” কীভাবে প্রকাশ করে তাও আমরা ভালো করেই জানি। এইসব বিষয় তাদের মধ্যে ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ে নিয়ে একরকম স্টিরিওটাইপ তৈরি করে।
আরও একটা প্রভাবক হচ্ছে দেশে হিজাব-পর্দার বৃদ্ধি আর এর স্বাভাবিকীকরণ। এর প্রচলন যত বাড়ছে, পুরুষেরা একে তত বেশি স্বাভাবিক মনে করছে, তাদের এক্সপেক্টেশনও বৃদ্ধি পাচ্ছে যে মেয়েদের এরকম পোশাকই পরা উচিৎ, তারা স্বপ্ন দেখছে তাদের গার্লফ্রেন্ড বা স্ত্রী এরকম পোশাক পরবে, না পরলে পরতে ম্যানিপুলেট করছে। আর যত বেশি হিজাব স্বাভাবিকীকৃত হচ্ছে, তত বেশি এরা হিজাবিদেরকেই ম্যাডোনা বা সতী ভাবছে, আর যারা হিজাব পরছে না, তাদেরকে হোর বা বেশ্যা ভাবছে, তাদেরকে গালাগালি করছে।

হিজাব ছাড়া, ওড়না ছাড়া মেয়েদেরকে এভাবে দেখার বিষয়টা আবার দুষ্টচক্রের মতো কাজ করে। পুরুষেরা এই মেয়েদেরকে বেশ্যা ভেবে তাদেরকে বেশি করে টিজ করলো, এর ফলে মেয়েরা এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হিজাব পরা শুরু করলো, তার ফলে পুরুষের কাছে হিজাব আরও বেশি নরমালাইজড বা স্বাভাবিকীকৃত হলো। আর তার কারণে এরা আরও বেশি টিশার্ট পরা, ওড়না ছাড়া বা হিজাব না পরা মেয়েদেরকে টিজ করা শুরু করলো। তার ফলে আবার মেয়েরা হিজাব পরা শুরু করলো…।
এই সমস্যা, এই দুষ্টচক্র থেকে বের হবার উপায় কী? এখন মেয়েরা যা করছে সেটাই করা উচিৎ। আরও বেশি করে এরকম টিশার্ট পরা উচিৎ, আরও বেশি করে এভাবে রাস্তায় নামা উচিৎ, প্রতিবাদ করা উচিৎ। এরফলে মেয়েদের এরকম পোশাকই পুরুষের চোখে স্বাভাবিক বা নরমাল হয়ে উঠবে, তাতে তাদের ভেতরকার সেই ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স কমবে, এক শ্রেণীর নারীকে পবিত্র ও এক শ্রেণীর নারীকে বেশ্যা বলে মনে করার প্রবণতা কমবে। মেয়েরা যদি এটা না করে ভয় পেয়ে সমাজ নির্ধারিত “মডেস্টি’ বা ‘শালীনতা” অনুসরণ করে, তাহলে আস্তে আস্তে তারা বরং ফাঁদেই পা ফেলবে…।