শরিফুল হাসান:
“বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম পা রাখি সেদিন থেকেই স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার। আমার বর আমাকে প্রায়ই বলত, এই সব বাদ দিয়ে বিসিএসের পড়া পড় কাজে দিবে, লবিং ছাড়া তুমি কোনদিনই শিক্ষক হতে পারবে না যত ভাল রেজাল্টই কর না কেন। আমি বলতাম লবিং করতে পারি আর না পারি আগে রেজাল্ট তো ভাল করি, নিজেকে সান্ত্বনা তো দিতে পারব যে লবিং ছিল না তাই শিক্ষক হতে পারিনি। সেই কথাই সত্যি হল! রেজাল্ট ভাল ছিল, ভাইভা ভাল হয়েছিল উপরন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান! কিন্তু এগুলা কোন কাজেই আসল না! যারা গত চারটা বছর আমাকে দেখেছে তারা জানে কি কষ্টটাই না করেছি!
আমি সারাদিন ক্লাস করে রাতে রান্না করে তারপর পড়াশোনা করেছি! এমনও হয়েছে রাতে রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে গেছে, পরদিন সকালে পরীক্ষা তাই ডাক্তারের কাছে না গিয়ে পড়ে সকালে পরীক্ষা দিতে গেছি! হাত দেখে কোর্স টিচার আঁতকে উঠে বকেছেন উলটো যে, পরীক্ষা পরে দিতে, আগে ডাক্তারের কাছে গেলে না কেন! সেসব কথা মনে পড়লে এখন অনেক কষ্ট হয়।
আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, ভাইভা বোর্ডে যিনি এক্সটার্নাল ছিলেন দুজনই আমার ভাইভা ভাল হয়েছিল বলে ভিসি স্যারকে বলেছিলেন আমাকে নেয়ার জন্য কিন্তু ভিসি স্যার তখন বলেছিলেন ওর তো এম এস শেষ হয় নি। কিন্তু রেজাল্ট দেয়ার পরে দেখা গেল আমার ব্যাচ থেকে আমার চেয়ে খারাপ রেজাল্টধারীরা নিয়োগ পেয়েছে, তাদের একজন আওয়ামী লীগ নেতার ভাতিজি আরেকজন ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছে! এক প্রভাবশালী শিক্ষিকা চাকরি দেবার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে ২০-২৫ লাখ করে টাকা নিয়েছে। তাদের মধ্যে যাদের চাকরি দিতে পারেন নি তিনি তাদের টাকাও আর ফেরত দেন নি!
ভিসি স্যারের পক্ষে তার যত আত্মীয় স্বজনকে চাকরি দেয়া সম্ভব ছিল সবাইকে দিয়েছেন। এত দুর্নীতি হল কিন্তু প্রতিবাদ করার কেউ নেই। আমার একবার মনে হয়েছিল আদালতে রিট করি ,পরে ভাবলাম তাহলে আমার এম এস ডিগ্রীটা শেষ করতে পারব না এখান থেকে। তাই আর কিছু করা হল না।”
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ছাত্রী আমাকে ইনবক্স করেছে। জানি না সারাদেশে কতো মেধাবীর এমন দীর্ঘশ্বাস আছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে জানতে চাই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ১১ বছরে আপনার তদবিরে কয়জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন? সংখ্যাটা যদি শূন্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন, গত ১১ বছরে অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে এবং আপনি যদি একজনের জন্যও তদবির না করে থাকেন, তাহলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কেন ধ্বংস হলো? অতীতেও এমন হয়েছে।
সব আগুন দেখা যায় না বলে হাজারও বঞ্চিতের কান্না হয়তো আমরা শুনি না। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধাররা যদি মনে করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের কিছু যায় আসে না, তাহলে বলার কিছু নেই। আর যদি মনে করেন কিছু যায় আসে, তাহলে বলবো, সমস্যার সমাধান করেন। কিছু যদি নাও করতে পারেন অন্তত একটা কোটা করে থাকেন যে ক্ষমতাশালীদের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা, যেখানে তদবিরই প্রধান। আর বাকি ৫০ শতাংশে সত্যিকারের শিক্ষক হওয়ার মতো লোকজন নিয়োগ পাবেন। আমি জানি না সবকিছু আর কতোটা ধ্বংস হয়ে গেলে আমাদের হুঁশ ফিরবে!
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)