মনুষ্যত্বহীন আদিম জাতি হয়ে উঠার সিরিজ…

সাবিরা শাওন:

কী যে দুঃসহ এক রাত পার করছি তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আর আমি জানি! গত কয়েকটি দিন শুরু হয়েছে দুঃসংবাদে আবার শেষ ও হয়েছে কোন না কোন খারাপ খবর দিয়েই। প্রতিটি দুঃসংবাদের সাথে পাল্টে যাচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর হিসাব।

একদিকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে আমার ছোট বোন, অন্য দিকে প্রথম আলোর পাতায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। দুঃশ্চিন্তা আর অসহায়ত্ব নিজের অজান্তেই গ্রাস করছে অনুভূতিকে। অসাড় মনে হচ্ছে নিজেকে। মৃত মানুষ গুলোর বীভৎস রুপ কেমন বিভীষিকার মতো চোখের সামনে জীবন্ত, কান পাতলেই বাতাসে শোনা যায় কতগুলো প্রাণের বাঁচার আকুতিভরা আর্তচিৎকার। ঘোরলাগা চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সারি সারি লাশের ব্যাগ। প্রিয়জনেরা লাশের সারির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পাগলের মত হাতড়ে যাচ্ছে প্রিয়মানুষের অস্তিত্ব।

সাবিরা শাওন

শিউরে উঠছি না মোটেও। কারণ মাত্র ১ মাস ৯ দিন আগে আমরা এর চেয়েও আগুনের ভয়াবহ রুপ দেখেছি চকবাজারে। চকবাজারের তুলনায় এই অগ্নিকাণ্ড রীতিমতো নস্যি। মাত্র ২৫ জন! আমাদের উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে থাকা দেশের কর্ণধাররা কাল হয়তো এ নিয়ে নিজেদের বক্তব্যের কোন এক লাইনে বলবেন, “বড়ে বড়ে উন্নতি কে লিয়ে অ্যাসি ছোটি ছোটি এক্সিডেন্ট হোতি রেহতি হ্যায়।”

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর সবার এত সচেতনতা, দায়িত্ববোধ পূর্ণ লেখা (আমিও লিখেছিলাম) সরকারের অভিযান এবং আমাদের দেশোদ্ধার করা স্ট্যাটাসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেলেও, দিনশেষে কে জয়ী? বাঙ্গালীর নষ্টামিই জয়ী হয়েছে। হ্যাঁ আমরা বাঙ্গালীরা নষ্টামো তে অস্কার ডিজার্ভ করি। তাইতো কয়েকটি টাকা বাড়ি ভাড়া বেশি পাওয়ার জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ভাড়া দিয়ে নিজের বাড়িকে বানিয়ে রাখি টাইম বোম্ব। এরপর যখন ফুটুস করে বোম ফাটলে পুড়ে মরি তখন সরকারের গুষ্টি উদ্ধার করি। সেই সরকার যদি গভীর ঘুম থেকে জাগার জন্য হালকা নড়াচড়া শুরু করে তখন আমরাই আবার তাদের ধইরা ঘুম পাড়ানি গান শুনাই। না হলে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম উচ্ছেদ অভিযানে আমরা কেন বাধা দেই? নিজেরা কেন একবার বলিষ্ঠ কন্ঠে আওয়াজ তুলি না? নষ্টামির শেষ এখানেই নয়। এখন যা বলবো তা শুধু নষ্টামিই নয় অমানবিকতার অনন্য উদাহরণ।

আমরা সত্যিই ইউনিক তাই আমাদের সব কাজ কারবারো ইউনিক। পরম্পরায় আমরা অকৃতজ্ঞ ও লোভী বলেই কি না; এমন এক প্রজন্ম তৈরি করেছি এবং রেখে যাচ্ছি যারা যাদের নিজেদের স্বার্থে এক মুহূর্তের মাঝে নিজের মনুষ্যত্ব কে বাক্সবন্দি করে কাজ উদ্ধার করি আবার একটু পর মূল্যবোধ নিয়ে লেকচার দেই।

আজ বনানীর বহুতল ভবনে আগুন লাগায় কিছু মানুষ বাঁচার তাগিদে যখন দিগবিদিক ছুটছিলো, আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো, আমরা তখন দাঁড়িয়ে ক্যামেরার অ্যাংগেল প্র‍্যাক্টিস করছিলাম। ক্যামেরার মুড আর ইফেক্ট সিলেকশন করতে গিয়ে ফুরসত পাইনি রাস্তা ফাঁকা করার। তাই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও ভীড়ের মাঝে ভবনের কাছাকাছি গিয়ে পানি দিতে পারেনি। দায়িত্ববোধ আমাদের কম জানি তাই বলে এমন নির্বিকার আমরা!!! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতার জোরে স্বার্থান্বেষী একটা মহল দিনের পর দিন ঢাকা শহরটাকে লাশের ভাগাড়ে পরিণত করছে। তারাই আবার নিজেদের অক্ষমতা কে ঢাকতে কাদা ছুড়াছুঁড়ি করে, অন্যায়গুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার পায়তারা করে।

এই ক্ষোভ, উদ্বেগ সবকিছু অর্থহীন আমাদের এই মগের মুল্লুকে। এখানে অনিয়ম আর অমানবিকতার দাপটে সত্য আর মনুষ্যত্ব ঘরছাড়া। দিনশেষে সবাই শুধু “আমাকে” নিয়ে ব্যস্ত। আমরা এই টুকুতেই তৃপ্তি পাই আমার ঘর ভরা থাকে বলে।

রাব্বি, আনজির, আবদুল্লা আল ফারুক এরা তো আমাদের ঘরের কেউ নয়। এর অপরিচিত কিছু মুখ, একটা দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া লাশ। এদের জন্য দু’দিন একটু দুঃখ দুঃখ ভাব থাকবে আমাদের। এরপর হয়ত কাল আবার কোন এক বাস উঠে যাবে কোন দিয়া, আবরার বা আপনার আমার ঘাড়ে নয়তো সকাল হতেই দেখবো নির্বাচন কমিশন নতুন আরেকটা কৌতুক রেডি করবে আমাদের কষ্টের হ্যাংওভার কাটানোর জন্য। আমাদের কি আর ইস্যুর শেষ আছে!

শেয়ার করুন: