আসুন, ম্রো মেয়েটির অপমানের প্রতিবাদ করি

সুপ্রীতি ধর:

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ম্রো নৃগোষ্ঠির এক মেয়েকে জনসম্মুখে জড়িয়ে ধরে আছেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান। তার নাম আবুল কালাম। বান্দরবনের আলীকদম উপজেলার নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান। উনি খুশির ঠ্যালায় আদিবাসী নারী সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছেন। ভেবেছেন, আদিবাসী মেয়ে তো, এর গায়ে হাত দিলে কোন সমস্যা নাই।

ছবিতে মেয়েটির অভিব্যক্তি থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কতোটা অসহায়, অপমান আর অস্বস্তি তিনি বোধ করছেন, সেইসাথে জোর করে চেয়ারম্যানের হাত থেকে ছুটে যেতে চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে চেয়ারম্যান তাকে জোরপূর্বক ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। সেই মুখটাও ভালো করে খেয়াল করুন, এতোটুকু অপরাধের লেশমাত্র নেই সেই চোখেমুখে। যেন এই কাজটি করতে পেরে বিশাল পরিতৃপ্তি সে পেয়েছে। ধিক্!

প্রচণ্ডভাবে গা গুলিয়ে উঠলো আমার। যদিও নতুন কিছু না এ ধরনের আচরণ। আমরা প্রতিনিয়ত এরকম অসংখ্য ছবিতে ফেসবুক সয়লাব হয়ে যেতে দেখি, ছোটবেলা থেকেই এমন অসংখ্য ঘটনার নানাবিধ শিকার আমরা নিজেরাও হয়েছি। কিন্তু তখন আমাদের মুখে ভাষা ছিল না, গলার স্বর উচ্চ ছিল না। এতো বছর এতো নির্যাতন পাড়ি দিয়ে যখন নিজেদের গলার স্বর খানিকটা উচ্চকিত করেছি, তখনও এরকম দৃশ্য কেন দেখতে হয় আমাদের? কেন?

আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠী এমনিতেই অনেক পিছিয়ে থাকা একটা গোষ্ঠী। বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে আছে তারা। আর তাই তাদের মেয়েদের জড়িয়ে ধরলেও শক্ত কোনো প্রতিবাদ তারা করতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়। তা না হলে সংবর্ধনা নিতে গিয়ে প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি করার মতো এতো বড় স্পর্ধা এই লোক দেখতে পারতো না। অথবা হয়তো সেই লোক বলবে, এ আর এমন কী! একটুখানি জড়িয়ে ধরে না হয় ছবিই তুলেছি!

আমি ভাবছি লোকটার আস্পর্ধা দেখে। এই ইতর ব্যক্তিটি কি মেয়েটিকে বা তার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েদের গণিমতের মাল ভাবে নাকি? অবশ্য যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাড়ি দিচ্ছি, তাতে করে যেকোনো নারীমাত্রই গণিমতের মাল, তাদেরকে জোর করে ছবিটির মতোন ধরে রাখা যায়, মেয়েটি প্রাণপন শক্তি দিয়েও বেরিয়ে আসতে পারছে না (ছবিতেই স্পষ্ট তা), নারীমাত্রই ভোগ্যপণ্য, ইতং-বিতং করে ছুঁড়ে ফেলা যায়, প্রেমের অভিনয় করে যৌন নিপীড়ন শেষে হাসি দিয়ে বলা যায়, ‘আমি তো বিয়ে করবো বলিনি’! এসবই সম্ভব এই ভূখণ্ডের পুরুষদের পক্ষে।

কিছুদিন আগে একটি ভিডিও দেখেছিলাম, সম্ভবত সেটি ছিল ভারতের কোন রাজ্যের। একদল কিশোর ছেলে একটি কিশোরী মেয়েকে রাস্তায় একা পেয়ে হামলে পড়লো, জামাকাপড় সব ছিঁড়ে ফেলে টেনেটুনে কোথায় জানি নিয়ে গেল। ভিডিওটি দেখার পর স্থির হতে পারিনি বেশ কদিন। মেয়েটির কী পরিণতি হতে পারে, তা বলা বাহুল্য। জানতেও চাইনি আর। কী করবো জেনে? কোন কাজে লাগছি আমরা? আমাদের চিল্লাচিল্লি তো ফেসবুক বা অনলাইনেই হাওয়ায় ভেসে যায়, মাঠ পর্যায়ে কোনোরকম হেরফের তো করতে পারছি না নারী জীবনের। আর সেখানে পাহাড়ের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ততোধিক অবহেলিত নারীদের অবস্থার কথা আর নাইবা বলি। বলার মতোন মুখও আর অবশিষ্ট নেই আমাদের। কী করেছি আমরা তাদের জন্য? কিছুই না।

লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট সাদিয়া নাসরিন লিখেছেন, এটা সুস্পষ্ট যৌন নিপীড়ন এবং প্রচলিত আইনে ফৌজদারী অপরাধ।
আপনারা কেউ কি মেয়েটার এই ট্রমা, এই অপমানের বোধ, এই যন্ত্রণার ক্ষরণকে বুঝতে পারেন? পারলে কেউ কি আমাকে বলবেন, কোন ক্ষমতা বলে একজন জনপ্রতিনিধি প্রকাশ্যে একজন নারীকে এভাবে যৌন নিপীড়ন করতে পারে? প্রচলিত আইনের আওতায় কি তার এই অপরাধের শাস্তি হবে? উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে তার শপথ গ্রহণের উপর কি নিষেধাজ্ঞা আসবে? পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কি এই কুলাঙ্গারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবে?

আমরা কি পারি না এই ম্রো মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে? জোরালো আওয়াজ তুলে এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাতে পারি না? যেন আর কোনো আদিবাসী নারীর দিকে এই লোকের মতো কোন অমানুষ চোখ তুলে তাকানোর আগে অন্তত দুবার ভাবে?

পাহাড়ি নারী বা মেয়েশিশু মানেই সহজলভ্য কিছু নয়, এটা এই ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দিতে হবে কড়ায়-গণ্ডায়।

হোক প্রতিবাদ।

শেয়ার করুন: