রুমানার স্বপ্নের সংসার

ফারজানা আকসা জহুরা:

রুমানার বিয়ে হয়েছিল প্রবাসী এক ছেলের সাথে। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে সেও চলে যায় বিদেশে তার স্বামীর কাছে। নতুন সংসারের শুরুতেই রুমানার স্বামী তার সকল কাজে কর্মে খুঁত ধরতে শুরু করেন। কাজ থেকে ঘরে ফিরে তার স্বামীর প্রধান কাজ হতো রুমানার দোষ-ত্রুটি ধরা এবং তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। রুমানার স্বামীর চোখে রুমানার গুণের চেয়ে দোষই বেশি ধরা পড়তো। আর রুমানার মতো মেয়েকে বিয়ে করে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে বিলাপ করতেন।

এমন অশান্তির মধ্যেই রুমানা প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে। রুমানা ভেবেছিল নিশ্চয় সন্তান হওয়ার কথা শুনে তার স্বামীর আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আসবে! কিন্তু না, তার স্বামীর আচার ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন ঘটে না, বরং তিনি আরও বেশি অত্যাচার শুরু করেন রুমানার উপর।

এদিকে রুমানার স্বামী অন্যদের সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করেন। আশপাশের কেউ অসুস্থ হলে, তাদের সংসারে ঝামেলা হলে, বউয়ের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হলে, তাদের সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। কারোর বউ প্রেগনেন্ট হলে তাদের ভারী কাজ করতে নিষেধ করেন।

ছবিটা অনলাইন থেকে পাওয়া। সীমান্ত রায় এঁকেছেন।

আর অন্যদিকে তিনি নিজের বউকে দিয়ে ভারী ভারী কাজ করান। ডাক্তার দেখানোর জন্য টাকা দেন না, কোনো কিছু কেনার জন্য বা খাবারের জন্য কখনো কোনো টাকা পয়সা দেন না। এমনকি তাদের বাসার বাজার তার স্বামী নিজে করেন এবং বাসায় কী রান্না হবে তা তার স্বামী ঠিক করেন। রুমানা কখনো নিজের পচ্ছন্দ কোনো খাবার রান্না করতে পারে না। আবার বাইরে থেকে কিনে খাবে, তাও পারে না। যদি কখনো রুমানা লুকিয়ে একটু নিজের মতো রান্না করেছে, কী ওমনি তার স্বামী ঠিক টের পেয়ে যায়, আর সেই রান্নার পাতিল আছার দিয়ে ঘর নোংরা করেন।

এমন খারাপ একটি অবস্থায় রুমানার সন্তান হয়। কিন্তু তাদের সম্পর্কের উন্নতি হয় না। রুমানার সিজার হওয়ার পরেও তার স্বামী তাকে দিয়ে দুনিয়ার সব কাজ করাতেন। এমনকি রাতে খেতে বসে রান্না পছন্দ না হলে হাঁড়ি পাতিল মুখে ছুঁড়ে মারতেন।

একদিন অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে রুমানা প্রতিবাদ করে এবং পুলিশের কাছে যাবে বলে হুমকি দেয়। রুমানার হুমকিতে তার স্বামী কিছুটা ভয় পায় এবং তিনি রুমানার কাছে মাফ চান। কিন্তু ঠিক এর কিছুদিন পরে তিনি রুমানার সাথে ঘুমানো বন্ধ করে আলাদা ঘরে থাকতে শুরু করেন।

স্বামীর এমন আচরণে রুমানা একটু কষ্ট পায়, কিন্তু স্বামীর প্রতি তেমন ভাব ভালোবাসা না থাকায় সে তার স্বামীকে তেমন কিছুই বলে না। বরং মেনে নেয়।

এভাবে রুমানা কথার মার খেতে খেতে পিঠের চামড়া শক্ত করে এবং প্রতিনিয়ত সে সাহসী হয়ে ওঠে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করে, একদিন সে ঠিকই তার স্বামীকে তালাক দিয়ে আলাদা হবে।

একবার রাতে খেতে বসে রুমানার স্বামী ছোট খাটো একটা কথার সূত্র ধরে রুমানার মাথায় পাতিল ভেঙ্গে ফেলে। ঠিক তখন রুমানা ঘর থেকে বের হয়ে যায় পুলিশের কাছে যাবে বলে। কিন্তু তার আগেই রুমানার শরীরে রক্ত দেখে আশপাশের প্রতিবেশীরা ছুটে আসে।
রুমানা ভেবেছিল আশপাশের কেউ তাকে সাহয্য করবে। সে মনে প্রাণে চাইছিল কেউ যেন পুলিশকে একটু খবর দেয়। কিন্তু না। তার প্রতিবেশীরা তাকে কোনো সাহায্য করেনি, বরং তার স্বামীকে সাবধান করে দেয়।

এতে তার স্বামী আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়, এবং হাতের বদলে নোংরা আর অশ্লীল ভাষায় রুমানাকে গালাগালি করা শুরু করেন।

রুমানা খুব ধৈর্যশীলা ছিল। কিন্তু ধৈর্যেরও একটা শেষ সীমা থাকে আর তাই একটা পর্যায়ে অসহ্য হয়ে সে বাচ্চাসহ পুলিশের কাছে যায়। কিন্তু পুলিশকে তার এলোমেলো সব কথা বুঝতে পারে না। পুলিশ যখন রুমানা প্রতিবেশীদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চায় তখন তারাও তেমন কিছুই বলে না। ফলে পুলিশও তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।

পুলিশের ঘটনাটা তার প্রতিবেশীরা রুমানার স্বামীকে জানিয়ে দেয়। অথচ রুমানার স্বামী বিন্দুমাত্র নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা না করে বরং রুমানাকে সবার কাছে চরিত্রহীন, খারাপ, লোভী মেয়ে প্রমাণের জন্য আজেবাজে কথা বলে বেড়াতে শুরু করেন।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধুমাত্র একটি চুক্তিপত্রের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বলে খুব সহজে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব। তাই একে অপরের প্রতি যদি শ্রদ্ধাবোধ না থাকে, যদি নিজেরা নিজেদের সম্পর্কের যত্ন নিজেরা না নেয়, যদি কেউ কাউকে সহ্য করতে না পারে, তাহলে সেই স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের মৃত্যু অনিবার্য।

রুমানার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। রুমানার প্রতি তার স্বামীর নোংরা আচরণ, সব কাজের খুঁত ধরা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে করতে তিনি নিজেকে রুমানার চোখে ছোট করে ফেলেছিলেন।

তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন না যে, প্রতিটি মানুষের এক একটি আলাদা সত্তা। আলাদা তাদের চিন্তা ভাবনা, পছন্দ- অপছন্দ। তাই এই আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বেশি সমালোচনা করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অন্যায়। প্রতিটা মানুষ তার নিজ বৈশিষ্ট্য আর গুণের কারণে অনন্য।

কিন্তু রুমানার স্বামী নিজের ভুল না বুঝতে পেরে প্রতিনিয়ত হিংস্র হয়ে ওঠছিল। অন্যদিকে রুমানা ইচ্ছে করলেই তার স্বামীকে তালাক দিয়ে দেশে ফিরে আসতে পারতো। কিন্তু সে দেশে ফিরে যায় না, সে ভাবে, দেশে গিয়ে কী হবে? তার চেয়ে আলাদা হওয়া ভালো। তাই সে চাকরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

রুমানা তার স্বামীর সাথে একই বাড়িতে থাকে, কিন্তু আলাদা বিছানায়, আলাদা ঘরে। প্রতিদিন সে রান্না করে তার স্বামীর জন্য, সন্তানের জন্য। যদিও খেতে বসে তার স্বামী রান্নার খুঁত ধরে আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।

খেতে বসে রুমানা লক্ষ করে যে, তার স্বামী তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে করতে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে, সে নিজেও বোঝে না সে কত জঘন্য আচরণ করছে! কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে রুমানাও দাঁত মুখ চেপে স্বামীর গালাগালি শুনতে থাকে।

বেঁচে থাকার তাগিদে রুমানা প্রতিদিন একটা করে স্বপ্ন বুনে। যে স্বপ্নে শুধু সে আর তার সন্তান থাকে। রুমানা ভাবে, নিশ্চয়ই একদিন সে একটা চাকরি পাবে, তখন তার একটা খুব সুন্দর বাড়ি হবে, তার একটা নিজের সংসার হবে। যে সংসারে কর্তৃত্ব ও চাবিকাঠি সবাই থাকবে রুমানার নিজের হাতে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.