মনের আশ্রয়

শাহরিয়া খান দিনা:

আদিম যুগের মানুষ আশ্রয় খুঁজতো বন্য প্রাণী এবং প্রতিকূল আবহাওয়া বিশেষত রোদবৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। পাহাড়ের গুহায় কখনো সমতলে যেখানে মনে হয়েছে সে নিরাপদ সেখানেই গড়ে নিয়েছে তার আশ্রয়।

কালের বিবর্তনে ইট-পাথরের শক্ত প্রাচীরে মানুষের মাথার উপর ছাদ উঠলো। মানুষ নিরাপদ আশ্রয় পেল। কেটে গেল রোদবৃষ্টি’র আশ্রয়ের চিন্তা। বন্যপশুর ভয় এখন তো আর নেই। উল্টো পশুরাই ভয় পায় মানুষকে।

ছাদ না থাকলে মাথার উপর যে শূন্যতা আমরা তাকে আকাশ নামেই জানি। সুরম্য অট্টালিকায় থেকে আজকাল আকাশ দেখা যায় না তাই বলে যে শূন্যতা নেই তা কিন্তু নয়। শূন্যতার বসতি এখন মানুষের বুকে।

মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে। সবকিছুই আছে। আছে পরিবার-স্বজন তবুও একাকী একেকজন। পাশে থেকে একজন জানছে না আরেকজনের মনে কি চলছে, কি তার প্রয়োজন! আসলে এত সময় কই? সবারই যান্ত্রিক জীবন। রুটিনবাঁধা জীবনে এলার্মের শব্দে ঘুম থেকে জাগা এরপরে যন্ত্রের মত একেক পর এক দিনের কাজগুলি শেষ করা। রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত।

এর মধ্যেই সচেতন-অবচেতন মনে নানা প্রশ্ন, ভয়, আশংকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃচিন্তা, নিরাপত্তাহীনতা এমন সব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তোলপাড় চলে ভেতরটায়। যা অদৃশ্য। এইসব চিন্তার উৎপত্তি স্থল হচ্ছে আমাদের মন। প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা আমাদের সবকিছু দিয়েই পাঠিয়েছে। যেমন আমাদের নখ, চুল এমনিতেই বাড়ে যার জন্য চিন্তা করতে হয় না। আমাদের চোখ এমনিতেই পলক ফেলে যার জন্য হুকুম দিতে হয় না। ঠিক তেমনি কোথাও ছোটখাটো কেটে গেলেও এমনিতেই তা ঠিক হয়ে যায়। যেমনটা পশুপাখিদেরও হয়।

যাদের আত্মিক শক্তি প্রচণ্ড রকম কিংবা মেডিটেশন করে মন নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ততা আনে, তারা সম্ভবত মানসিক একাকিত্বে কম ভোগেন, বা ক্ষেত্রবিশেষে একাকিত্বকে উপভোগ করতেও শিখে যান। কিন্তু আমাদের বেশীরভাগেরই মনের ভেতরে সব কেন যেন এমনি এমনি ঠিক হয় না। কোন কোন সময় এমনও দেখা যায় মনের উপর কোন কন্ট্রোল থাকে না। এই পরিস্থিতিতে আমারা অসহায় বোধ করি। খুব নিঃসঙ্গ লাগে। ৭০০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে একটা দ্বীপের মতো একাকি একজন।

পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গা, শিশিরজলে পা মাড়িয়ে পথচলা, দায়িত্ব-কর্তব্যের বোঝাহীন একটা জীবন একদিন আমারও ছিল। ছিল রঙিন কিছু স্বপ্ন। যে জীবন এখন করছি যাপন তা কি আমার নাকি অন্য কারো! এমন কিছু আত্ম-জিজ্ঞাসায় গভীর রাতের নিস্তব্ধতার অন্ধকারে চোখ হয়তো ভিজে উঠে কারো।

বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা, শো-অফ, চেক-ইন, সেলফি সবাই আমরা সুখী। আসলেই কি সুখী, নাকি অভিনয়? এই সুখী সুখী চেহারায় অভিনয় করতে করতে কখন ক্লান্তি আসে। মন খুলে কাউকে বলতে ইচ্ছে করে একান্ত কিছু কথা। যে বুঝবে আমার মতো করে। পরম আদর মাখা গলায় বলবে, আর কেউ না বুঝক আমি তো বুঝি! আর কেউ না থাকুক আমি তো পাশে আছি! থাকব আজীবন।

দ্বিধাহীনভাবে তাকেই বলা যাবে আমার সাথে ঘটে যাওয়া, ভালোলাগা-মন্দলাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার আদ্যোপান্ত। খুব খারাপ লাগা মুহূর্তে নিজে কোন ভুল আচরণ করে ফেললেও তাকে হারানোর ভয় নেই একদমই। এমন নির্ভরতার একটা আশ্রয়ই মনের আশ্রয়। এমন একটা নিজস্ব মানুষ সবারই দরকার হয়।

যদি জীবনসঙ্গী এমন হয় তো নিঃসন্দেহে পৃথিবীই তার কাছে স্বর্গ। জীবনসঙ্গী না-ই হলো, এমন কেউ একজন থাকতে হয়। থাকাটা জরুরি। হতে পারে সে মা-বাবা, ভাইবোন বা আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে কেউ, কিংবা একদমই বিশেষ কেউ। তখন স্বর্গ না হলেও মনে হয় পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়। এমন আত্মার কাছাকাছি কেউ না থাকাটা মৃত্যুর মতোই একাকিত্বের।

শহুরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ব্যস্ত জীবনে চাওয়া-পাওয়ার অমিল যেখানে নিত্য সঙ্গী ডিপ্রেশন নামক রোগের সেখানেই বসতি। এই ডিপ্রেশন কীভাবে মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ টের পায় না। কেউ আত্মহত্যা করেছে শুনলে আমারা আহা-উহু করি, কিন্তু বেঁচে থাকতে খবর নেই না। পরম মমতায় জিজ্ঞেস করি না তার কী সুখ, কীসে তার আনন্দ! সাহস দিয়ে বলি না, ব্যাপার নাহ সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। তুমিই ঠিক করে নিতে পারবে।

কুকুর-বিড়ালও আদর চায়। মনযোগ চায়। সেখানে মানুষ তো সবচাইতে অনুভূতি প্রবণ প্রাণী। জরুরি মানের আশ্রয় মানেই ফিজিক্যালি সারাক্ষণ কাছে থাকা। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করা। কারণ হাত ছোঁয়া দূরত্বে থেকেও কেউ থাকে যোজন যোজন দূর, আবার কেউ দূরে থেকেও একান্ত কাছের জন। হৃদপিণ্ডের বাঁ’দিকের স্পন্দনের মতোই লেগে থাকা আপন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.