নাফিস কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার নয়

Nafisতানিয়া মোরশেদ: যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে আটক বাংলাদেশী নাফিসকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য ফেইসবুক/বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়াতে দেখলাম। যখন তাকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখন অধিকাংশ মানুষই বলেছিল ষড়যন্ত্রের কথা। বলেছিল, নাফিস ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার প্রশ্ন, কেন?

বাংলাদেশে জামাত/শিবির/জিহাদী দল নেই? তারা কি অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ব্রেইন ওয়াশ করে না? আজ থেকে ২৫/৩০ বৎসর আগে দেখেছি শিবির কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের দলে টেনে নিতো (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে)। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই সেই কাজটি করছেন (জামাত/শিবির বানাচ্ছেন)। এই জামাত/শিবির/রাজাকার/ধর্মান্ধ/জিহাদী মনভাবাপন্ন মানুষ কোথায় নেই?

মিডিয়াতে দেখলাম বাংলাদেশী আমেরিকান রিজোয়ানের খবর। নীচে মন্তব্য, আবারও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের। কেউ আবার লিখেছেন, সে আমেরিকায় গিয়ে জিহাদী হয়েছে, এর সাথে বাংলাদেশের কোন সম্পর্ক নেই। একজন যখন বাবা-মা বা অন্য প্রাপ্তবয়স্ক অভিভাবকের কাছে বেড়ে ওঠে, তখন তার সব বিষয়ে (মন মানসিকতার বিকাশও এর মধ্যে পরে) দায় দায়িত্ব কার কতটুকু? পরিবার সবচেয়ে আগে আসে। পরিবারের কাছ থেকেই প্রথম শিক্ষাটা পায় একজন সন্তান।

আমার ২০ বৎসরের প্রবাস জীবনে দেখছি, বাংলাদেশী বাবা-মা’রাই শুধু নন, এশিয়ান বাবা-মা’রা সন্তানদের সব বিষয়ে কি রকম জড়িত থাকেন (ব্যতিক্রম আলোচনার বিষয় নয় এখানে)। এর আগেও বলেছি, বর্তমান প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকাংশের মনোভাব হচ্ছে, অতি ধার্মিক হওয়া। আরবি শিক্ষার জন্য সন্তানদের সান-ডে স্কুলে দেওয়া, যার শিক্ষকরা বেশীর ভাগক্ষেত্রেই বাংলাদেশী নন। বাংলাদেশী বাদে অন্যান্য দেশের মুসলমানদের (বিশেষত “ইসলামিক” দেশগুলোর মানুষরা প্রথমে “মুসলমান” তারপর মানুষ, এভাবেই বেড়ে ওঠেন, ব্যতিক্রম আলোচ্য বিষয় নয়)। সেই শিক্ষকদের কাছে থেকে বাংলাদেশী বাচ্চারা যে শিক্ষা পান তা চিন্তা করে দেখবার বিষয়। যাদের চিন্তায় ধর্মের জন্য জীবন, জীবনের জন্য ধর্ম নয় সেখানে অনেক সময়ই ধর্মান্ধতা চলে আসবে নাকি? যে স্টিং অপারেশন নিয়ে কথা হচ্ছে সেই পদ্ধতিতে চাইল্ড প্রেডেটরদেরও ধরা হয়। সে বেলায় যদি আমরা কোনো প্রশ্ন না করি তাহলে এবেলায় কেন বিচারের আগেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী হবো?

জিহাদী/তালেবান সব আমেরিকান সরকারের তৈরি বলে যারা ভাবছেন, “এখন বোঝো ঠ্যালা” তাদের বলছি, আপনার সন্তানকে কোন পৃথিবী উপহার দিচ্ছেন? ধর্মের নামে যুদ্ধ আজ নতুন কিছু নয়। আমার কাছে “ধর্ম” আর “যুদ্ধ” শব্দ দু’টি খুব কাছাকাছি মনে হয়, এখন। মানুষ যতদিন ধর্মকে অন্তরে ঠাঁই না দেবে, যুদ্ধ চলবে ততদিন।

এবার আসি আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়। ঈদের পার্টিতে একজনকে ইন্ডিয়ান বাংলা চ্যানেলের সিরিয়াল দেখার বিষয়ে কিছুটা কথা শুনাচ্ছিলেন দু’ একজন, মজা করে। এরমধ্যে একজন হঠাৎ বলে বসলেন, তার বর একদম পছন্দ করে না, “হিন্দু চ্যানেল বন্ধ করো” বলেছেন একদিন। পর মুহূর্তে নারীটি বললেন, “সরি, ইন্ডিয়ান চ্যানেল”। তার সেই বর একদিন আমাকে ভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, মানুষ যে বলে ভুল করে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি তা আসলে ঠিক নয়। মানুষ তাই বলে, যা সে বিশ্বাস করে মনে। এবার মুখ ফসকে কথাটা কে বললেন, সেই নারী না তার বর, তাই ভাবছি!! এ ঘটনার কিছু পরে আর এক নারী সাথে আরেকজনকে নিয়ে এসে বললেন, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আসলাম। যিনি বলছেন, তার সাথে আমার পরিচয় নেই, কয়েকবার দেখা হয়েছে। এখানে এসেছেন কিছু মাস বা বৎসর খানেক আগে। আর দ্বিতীয়জন একদম নূতন এখানে। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে আমাকে দেখিয়ে বললেন, “এখানে একজন দিদি থাকেন, বাংলা অনুষ্ঠান করেন, বাংলা স্কুল করেন (আসলে করতাম, এখন অন্যরা করছে) বলেছিলাম না!” মহিলা কিছুক্ষণ “দিদি দিদি” করে চলে গেলেন। নূতন জন “দিদি দিদি” বলে কথা বলছে, এমন সময় আগে থেকে পাশে বসে থাকা এক নারী ‘আপা’ না বলে ‘দিদি’ বলা শুরু করলো (সে আপাই বলে)। না দিদি ডাক আগেও শুনেছি, তবে যারা ডাকে তারা ইচ্ছে করে, পছন্দ করে, ভালবেসে ডাকে। বিশেষ কারণে নয়। স্পষ্ট করে বলি, প্রথম মহিলা আমাকে না চিনেও দ্বিতীয়জনকে নিয়ে এসেছেন, দ্বিতীয়জনকে আর কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন না, দ্বিতীয়জনের সিঁথিতে সামান্য সিঁদুরের দাগ। প্রথম নারীর মাথায় হিজাব। তার ধারণা, দ্বিতীয়জনের সাথে সিঁদুরসহ বা সিঁদুর ছাড়া “বিশেষ” কারো সাথে পরিচিত হতে হবে। (বিশেষ একজন, মানে হিন্দু)।

এ ঘটনা আমার বন্ধুদের মাঝে মাঝেই মোকাবেলা করতে হয়। মানে  হিন্দু কেউ কমিউনিটিতে আসলে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেহেতু সে হিন্দু তাই তার সাথেই হিন্দু কেউ এলে পরিচয় করিয়ে দিতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে!! প্রথমজন আমাকে হিন্দু ভেবে সেই কর্তব্যই করেছেন!! আমার হিজাব নেই, হালাকায়, কোরাণ স্টাডিজে দেখেন না/কোথাও কোনো ধর্মীয় কিছু করতে দেখেন না, তাই ‘অমুসলমান’ ভাবলেন। হিন্দু ভাবলেন কেন, কেন খৃষ্টান, বুদ্ধিস্ট, নাস্তিক বা অন্য কিছু নয়?  না হিন্দু ভাবলে আমার কিছু যায় আসে না, আমার প্রশ্ন কেন আমাকে দেখে আমার গায়ে ধর্মের “লেবেল” দিতে হবে কারো? আমাকে মানুষ হিসাবে দেখা যায় না? কেন কাউকে দেখেই ভাবতে হবে, সে কোন ধর্মের?

(লেখক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.