শাহাজাদী বেগম:
দিবস উদযাপনের তাৎপর্য বুঝেছি এনজিও’তে কাজ করতে এসে, সেটাও দেড় যুগ আগে। উদ্যমে, উদ্যোগে, স্লোগানে মুখরিত একটি দিন কাটাতে সত্যিই ভালো লাগে। কিন্তু দেড় যুগ পরে এসে কিছু গুনগত পরিবর্তন না পেলে মন ভরে না, ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চাই। এটা অনেকটা নিজের কাছে নিজের মূল্যায়ন কিংবা নিজের দায়বদ্ধতাকেও যাচাই করে নেওয়া।
দেড়যুগ পরে এসে যখন দেখি জেন্ডার ফোকাল পার্সন, সেইদিনের গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেওয়া আমার নারী সহকর্মীটি, ১৬ বছর আগে স্বামীর বিরুদ্ধে করা কেইসটি তুলে নিয়ে একই মশারির নিচে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছে, আপনারা বুঝতে পারছেন নিজের সাথে তাকে প্রতিনিয়ত কতটা যুদ্ধ করতে হয়? কতটা প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে নিজের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে কাটাতে হয় বাকি জীবন!
আমি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চাই – পরিসংখ্যানে নয়, আমার চোখে দেখা মানুষগুলোর জীবনে।
যখন দেখি ২০ বছর জেন্ডার নিয়ে কাজ করা “মুখরা” হিসাবে পরিচিত আমার টিমের নারী সদস্যটিকে আজও তার স্বামী রাতের অন্ধকারে বুকে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে, কলেজে পড়ুয়া ছেলেটির সামনে গায়ে হাত তোলে- বুঝতে পারেন কতটা খারাপ অবস্থায় পড়লে তাকে এসব সহ্য করে একই ছাদের নিচে থাকতে হয়? আমি এখন আমার চেনা নারীদের অসহায় অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন পেতে চাই।
১৪ বছর আগের মেন এনগেইজমেন্ট (নারীর সমানাধিকারে পুরুষের অন্তর্ভূক্তি) নিয়ে কাজ করা তরুণ সুদর্শন পুরুষ সহকর্মীটিকে এখন যখন দেখি একের পর এক বিয়ে, একাধিক নারীকে প্রতারণা, গৃহকর্মি মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে, তখন একটি দিবস উদযাপন আমার কাছে আর কোন অর্থ বহন করে না।
আমি যখন আমার পুরুষ বন্ধুটির সাথে অফিস শেষে আড্ডা দিই, ঘরে তার চরম একাকিত্বে ভোগা গর্ভবতী স্ত্রী আকুল হয়ে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় থাকে- আমার একবারও মনে হয় না বন্ধুটির তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। এখন যে তার বউয়ের প্রতি আরো মনোযোগী হওয়া, আরো যত্নবান হওয়া দরকার, আমি একবারও মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি না। বরং বাড়িতে গিয়ে বোরিং হওয়ার চেয়ে তাকে উৎফুল্ল রাখতে আড্ডার সময় বাড়াই, মেসেঞ্জারেও সময় দিই। আমি কিন্তু জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, দেশে ও বিদেশে আমার যথেষ্ট সুনাম আছে। সত্যি বলছি, বছরের পর বছর ধরে উদযাপন করা দিবসটি তখন বড়ই অর্থহীন লাগে।
সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ছটফটে মেয়েটি যখন প্রেমিকের হাত ধরে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর, বাপের বয়সী সুপারভাইজারের লোলুপ দৃষ্টিতে ইন্টার্ন মেয়েটি কুঁকড়ে যায়, অভিনব কৌশলে অশালীন প্রস্তাবের সাথে প্রতিমূহূর্তে বোঝাপড়া করতে গিয়ে কাউকে কাউকে যখন আত্মসমর্পণ করতে দেখি, একটি বিশেষ দিন উদযাপন তখন শুধুই উপহাস মনে হয়।
দাতা সংস্থার উচ্চ পদস্থ বুড়ো ভাম যখন ফিল্ড ভিজিটে যায় সাথে সহযোগী সংস্থার নির্দিষ্ট মেয়েটিকেই পাঠানো হয়। উভয় সংস্থার সকলেই চেয়ে চেয়ে দেখে, কেউই প্রতিবাদ করে না “মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং” এর ফ্রেমে ফেলে দেয়।
কীভাবে বলি সেটি মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং? মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য দুজনেরই মেন্টাল ম্যাচিউরিটি লাগে, অবস্থা ও অবস্থানের সমন্বয় লাগে যেন কখনোই কোন অবস্থাতেই মনের মাঝে “ফাঁদে পড়া, ফাঁদে ফেলা” কিংবা “প্রতারিত হওয়া, প্রতারিত করা” বিষয়গুলো উঁকি না মারে। সেখানেও পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ রাখাটা জরুরি। কিন্তু প্রায়শঃই দেখি এমন মানুষগুলো কিছুদিন পরেই একে অন্যকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। সম্পর্কটি আসলে “মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং” ছিলই না। আমি অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চাই দিবস উদযাপনে নয়, বরং নিজ নিজ জায়গায় প্রতিবাদে, প্রতিকারে, স্বাধীনতায়, স্বকীয়তায়।
নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ-হত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদের উর্ধ্বহার, ৪ মাসের শিশু থেকে ৬৮ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত যখন ধর্ষণের হাত থেকে মুক্তি পায় না, বিচারপ্রার্থীর লাইন যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, ধর্ষক-খুনীরা বুক ফুলিয়ে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় “মিউচুয়াল আন্ডার্স্ট্যান্ডিং” যখন বহুগামিতার হালাল “টুল” হিসাবে প্রমোটেড হয়, তখন একটি দিবস উদযাপন আমার কাছে বিশেষ কোন অর্থ বহন করে না।
প্রতি বছর প্রতিপাদ্যের পরিবর্তন হলেই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হয় না, সেটা বুঝবেন ফেইসবুকে যেকোনো পত্রিকার নিউজের নিচের কমেন্টগুলো পড়লেই, ৫৭ ধারা যেগুলো দেখে না। আমি ইতিবাচক পরিবর্তন গুনতে চাই আমার চেনা মুখগুলোর, আমার কাছের মানুষগুলোর জীবনে।
এই লেখাটির পড়ে হয়তো অনেকেই আমাকে বয়কট করবেন, জানি। তবু নিজের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে পারি না কিছুতেই- প্রশ্নবোধকে আমিও, আমরাও।
লেখক: উন্নয়নকর্মী: