নিজেকে ‘ব্যস্ত’ দেখানো পুঁজিবাদেরই চর্চা

আনন্দময়ী মজুমদার:

১) ব্যস্ত থাকা এক নেশা। অনেকে যে প্রচণ্ড ব্যস্ত, সেটা আমরা দেখতে পাই। ভালো লাগুক না লাগুক, মনে করি যারা সবসময় ব্যস্ত ব্যস্ত আর ব্যস্ত, তারা নিশ্চয়ই খুব উঁচু দরের লোক। এই ব্যস্ত থাকার সঙ্গে আত্ম-মূল্যকে তুলনা করি। তাই হয়তো স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে অনবরত হাত রেখে নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমরা অকাজের না, খুব কাজের, আমরা জীবনের প্রতিমুহূর্ত ব্যস্ততায় কাটাচ্ছি।

গাছও অনেক কাজ করে। পাখিও। কিন্তু তাদের ব্যস্ততা অদৃশ্য, ধীর, গভীর আর প্রাকৃতিক, তাই ভারসাম্য নষ্ট করে না। অন্যকে বিপন্ন ও বিচ্ছিন্ন করে না।

২) হাই ফাঙ্কশনিং কো-ডিপেন্ডেন্ট শব্দটা শিখলাম।

‘হাই ফাঙ্কশনিং’-এর মানে সেরকম মানুষ যিনি সব সময় ব্যস্ত আছেন, কিছু না কিছু প্রজেক্টে। না থাকলে যার অস্বস্তি হয়। কারণ নিজের কাছে আর অপরের কাছে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি একটা কাজের জীবন যাপন করছেন।

‘কো-ডিপেন্ডেন্ট’ মানে যিনি মনে করেন তার পরিধির ভেতরে এমনকি বাইরেও কেউ যদি সমস্যায় পড়ে, তার নৈতিক, শারীরিক, মানসিক মুশকিল আসান তাকেই হতে হবে, এবং তিনি বাধ্যত হবেন। নিজের পরিধির কারো মুড খারাপ হলে সঙ্গেসঙ্গে তার মুড খারাপ হবে। কাছের মানুষের অসুখবিসুখ হলে তিনিও বিপর্যস্ত হয়ে যাবেন। অর্থাৎ অন্যের পরিস্থিতি আর ইমোশন শুষে নেবেন, আর নিজের ভালো না-থাকার জন্য অন্যদের দায়ী করবেন। অন্যদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকবেন যে নিজের দিকে খেয়াল রাখার সময় পাবেন না। অথবা নিজের যত্ন নেবার কঠিন কাজে এভাবে না বুঝেই আসলে ফাঁকি দিয়ে যাবেন।

৩) আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মহিলা হাই ফাঙ্কশনিং কো-ডিপেন্ডেন্ট। একটু খেয়াল করলে দেখব ঘরে ঘরে বেশির ভাগ মহিলারাই তাই। সম্প্রতি একটা স্যাম্পল দেখে জেনেছি শুধু এ দেশে না, পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশেও একই হাল, শুধু কম আর বেশি।

এবার ভাবি, সমাজকে যদি বোঝানো যায়, এই অবস্থা একটা অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা, আর আমরা ভারসাম্য খুঁজি, তাহলে সমাজটা কেমন হতে পারে?

সকলের নিজের যত্ন নিচ্ছে, অসুবিধায় পড়লে শান্তিপূর্ণ সীমারেখা রচনা করছে, সাহায্য চেয়ে নিচ্ছে, কেউ সাহায্য চাইলে তবে তা দিচ্ছে, অযাচিত উপদেশ আর রায় দিচ্ছে না, জবাবদিহিতা চাইছে, জবাবদিহিতা দিচ্ছে, দায়িত্ব পালন করছে, নিজের প্রতি, অন্যদের প্রতি, মুড ভাল রাখতে পারছে, আর কাউকে অভিযোগ না করে বেশির ভাগ সময় ভাল থাকতে সঠিক রাস্তা চিনে নিচ্ছে। সে রাস্তা নেশার রাস্তা না। স্মার্ট ফোন, টিভি, অথবা ব্যস্ত থাকার রুটিন না। নিজের থেকে নিরন্তর পালানো না।

৪) হাইফাঙ্কশনিং ‘কর্মী’ না, আমাদের বেশি দরকার ‘নিজের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাস্থ্যবান, সুখী অস্মিতা’। নিজেকে যারা খুঁজে পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে। এবার বাইরের যত ‘লাইক’ ইমো, সে সব এক্সট্রা।

তার মানে যে সে অলস বসে আছে তা হয়তো না। নিজের মতো হওয়ার সাহস সে বজায় রেখে নিজের স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দিব্যি আছে। কেউ বুঝুক না বুঝুক। নীরব বৃক্ষের মতো। পাখির মতো। রোজ তার পাতায় রোদ পড়ছে, বৃষ্টি ঝরছে, মাঝে মাঝে ফুল আসছে।

৪) আমার দেখা আমেরিকার (অস্ট্রেলিয়া, ইউকে এর সঙ্গে ধরা যায় হয়তো) মধ্যবিত্ত জনগণ সকলেই হাই-ফাঙ্কশনিং। জীবনের সার্থকতা তুলে ধরতে হলে তাদের সকলকে দেখাতে হয় তারা কত কাজ করেন, কত ব্যস্ত, তাদের এই মুহূর্তে কত শত প্রজেক্ট আছে, এর সঙ্গে সেলফ-রাইচাসনেস যুক্ত হয়, কারণ পুঁজিবাদী সমাজ শেখাতে থাকে, তুমি সফল প্রজেক্ট দেখাতে না পারলে তুমি ফান্ড পাবে না, স্কলারশিপ পাবে না, তুমি অপদার্থ, তুমি বাতিলের খাতায়।

তাই সকলেই যারা সমুন্নত জীবন চাইছে, তারা সেখানে হাই-ফাঙ্কশনিং।

আমরা জাতি হিসেবে যেহেতু আমেরিকার লাইফ-স্টাইল লেইমভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করছি, সেই জন্য এই লেইম দিকগুলোকেই আমরা অনুসরণ করছি প্রাইভেট সেক্টরে আর ইস্কুলে। ওরা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এই ভুলের কেতাব শেষ করে একটু একটু, আমরা তখন ভুলের অধ্যায় ১-এ।

আমরা জানি না এই পর্যায় পেরিয়ে উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ সোশ্যালিস্ট দেশে কী কী হচ্ছে! আমরা জানি না আমাদের নিজেদের দর্শন আর বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহ্য আমাদের নিজের স্বভাবের অনুসন্ধান করতে বলে।

৫) যে মানুষ সবসময় ব্যস্ত থাকাকে তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না বলেই পছন্দ করে না, অন্তরে ধীর, পাহাড়ের মতো স্থির আর আত্মবিশ্বাসী, হয়তো বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ঢিলেঢালা, শশব্যস্ত নয়, কচ্ছপের মতো প্রজ্ঞাবান আর ধীর। চীনা ঐতিহ্যে খরগোশকে নয়, ধীর দীর্ঘমেয়াদী কচ্ছপকেই প্রজ্ঞার আধার হিসেবে দেখা হয়।

অথবা যে অফিসের ইস্কুলের কারিকুলামের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চায় না, ভালোবাসে না, অন্য রকম তার মতো, যার এই বাহ্যিক বেগ ভাল লাগে না, তাকে বাতিল করা হয় ইস্কুল থেকেই। সেটা যেন তার অনুচিত। তাকে লজ্জা দেওয়া হয়। যেন সে অলস বা দয়ার পাত্র। লজ্জা দিয়ে এক ঢালাইয়ে ঢেলে নেবার চেষ্টা হতে থাকে।

৬) কিন্তু কেউ যদি এ কথা বুঝতে শুরু করে যে ‘করা’ আর ‘বাঁচা’ এক কথা নয়। আমরা হিউম্যান-ডুইং না আমরা হিউম্যান-বিইং।

৭) আমাদের আত্মমূল্য সকলের সঙ্গে সমান। হরিপদ কেরাণী আর সম্রাট আকবেরর আত্মমূল্য সমান, মনে আছে রবি ঠাকুরের সেই কবিতা, ‘বাঁশি’?

৮) ঠিক নিজেদের মত হওয়ার জন্য সমাজের সমালোচনা আর বাতিল হবার শাস্তি আমাদের পেতে না হোক। আমরা স্বয়ম্ভূ আর ‘সবাই রাজা’। এক ইউনিফর্ম পরা এক কাজ করা এক ধাঁচে গড়া রাজা না। সকলে আলাদা।

কাল কুম্ফু পাণ্ডা ৩ সিনেমাটা দেখতে গিয়েও দেখলাম এই পয়েন্টটা তুলে ধরা হয়েছে। একজন সার্থক গুরু তিনি, যিনি জানেন কার কোন জিনিসটা সব থেকে শক্তিশালী, আর জানেন সেটা সকলের মধ্যে আলাদা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.