ফাহমি ইলা:
নারী দিবস গেলো। আমি চুপচাপ চোখ বুলাই সবার বক্তব্য, স্ট্যাটাস, প্রত্যাশার হালখাতায়। আমার দীর্ঘশ্বাস বেরোয়, আমি কিছু লিখতে পারি না, আমার হাত চলে না, মগজ খোলে না। আমি কি তবে হাল ছেড়ে দেয়া সেই অবসাদগ্রস্থ পথিক? নাকি পিতৃতন্ত্রের আফিম খেয়ে নেশাগ্রস্ত সেই মানুষ, যার নেশাগ্রস্ত মগজে যুক্তিবোধ কাজ করে কিন্তু পথের দিশা খুঁজে পায় না?
নারীকে মহান করবার একটি পিতৃতান্ত্রিক সুক্ষ্মচাল আজকাল বড় বেশি নজরে পড়ে। যেই মহানুভবতার মালা পরে নারী নিজেও গর্ববোধ করে। নারী আসলে মহান কখন? নারী মহান আসলে নারীত্বেই। পুরুষ মহান বিশ্বজয়ে, পুরুষ মহান আবিষ্কারে, পুরুষ মহান বিজ্ঞানে, পুরুষ মহান যুদ্ধজয়ে, পুরুষ মহান অর্থনীতিতে, পুরুষ মহান সমাজ সেবায়, পুরুষ মহান পুরুষত্বে। অন্যদিকে নারী মহান মাতৃত্বে, নারী মহান পতিভক্তিতে, নারী মহান সংসারে, নারী মহান পুরুষের সেবায়, নারী মহান দাসজীবনে, নারী মহান ত্যাগে, নারী মহান নারীত্বে।
আমাদের মা মহান আমাদের পরিবারের সবার কাছে। কেননা মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হবার পর থেকে সংসারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। হরহামেশা আত্মীয়রা বলতেন-‘জেসমিন, তুমি আসলে মহান। এতো অল্প আয়ে সন্তান সংসারকে আগলে রেখেছো। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছো একদম’।
আমার মা নিজের খাবারের কথা ভাবেননি, জামাকাপড়ের কথা ভাবেননি, শরীরের কথা ভাবেননি, নিজের অসুখের কথা ভাবেননি, নিজের স্বপ্নের কথা ভাবেননি, তাই তিনি মহান। আমাদের মা আমাদের বাবার নানান কটুকথা, যন্ত্রণা সহ্য করেছেন তাই তিনি মহান। আমার শ্বাশুড়িকে সবাই মহান বলেন। কেননা একপর্যায়ে স্বামী খোঁজ না নিলেও তিনি চার-চারটি সন্তানকে আগলে রেখে সেই স্বামীর পায়ের নিচেই স্বর্গ খুঁজেছিলেন, তাকে নতুন করে জীবন শুরু করবার কথা বললেও তিনি নিজের সুখের কথা কোনদিন চিন্তা করেননি, তার সকল সুখ নিহিত ছিলো তিনটি কবুলের বৃত্তেই।
পুরুষের চোখে নারী মহান আত্মত্যাগে, সংসারধর্মে, একগামীতায়, ধৈর্য সহিষ্ণুতায়, রক্ষণশীলতায়। যে নারী যত বেশি নিজেকে ত্যাগ করতে পারবে সে তত মহান। নারী কেবলমাত্র মহান ‘যোগ্য মাতৃত্বে’ আর ‘যোগ্য স্ত্রীত্বে’। নারী দিবসে সেই নারীদের কথা মনে পড়ে? যারা প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে, ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত শুনতে থাকেন সেক্সিস্ট বাক্য। যারা পুরুষের সমান পরিশ্রম করে, যোগ্যতার পরিচয় দিয়েও ‘পুরুষের চেয়ে দুর্বল’ খেতাব পান। যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখবার পড়েও শুধুমাত্র নারী বলে মূল্যায়ন পান না। যারা শুধুমাত্র নারীলিঙ্গ নিয়ে জন্মাবার কারণে ধর্ষনের শিকার হন, পথে-ঘাটে ঘরে বাইরে সহিংসতার শিকার হন। যারা অর্থনীতির বাজারে প্রবেশ করে উপার্জন করবার সাথে সাথে সংসারকেও একা হাতে সামলান। আজ পর্যন্ত যাদের গৃহস্থালী কাজের কোন অর্থনৈতিক ভ্যালু নেই। এ সকল কিছু এবং আরো অনেক কিছু সহ্য করে মুখ বুঁজে থাকলেই তবে নারী ‘মহান’।
‘মহান নারীদিবসে’ আমি শুধু এই ‘মহান’ ‘আত্মত্যাগী’ তকমা থেকে মুক্ত হতে চাই। আমি এই তথাকথিত মহানের বেড়াজালে আটকে না থেকে চিৎকার করতে চাই, প্রতিবাদ করতে চাই, আমার যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন চাই, সেক্সিস্ট বাক্যের বিষঝুড়িটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই মহাশূন্যে, জেন্ডার স্টেরিওটাইপ আফিম থেকে মুক্তি চাই। আমি চাই এ পৃথিবী আমারো হোক, পুরুষের চোখে বিশ্ব দেখতে চাই না, নিজের যোগ্যতায় খুঁজে নিতে চাই স্বাধীনতার স্বাদ।
পুরুষের তকমায় মহান হয়ে মুকুট পরবার চেয়ে নিজের যোগ্যতায় এক টুকরো স্বাধীন ঘাসফুল হওয়া ভালো।