ইয়াকুব আলী:
পরিবারে নারী বলতে একসময় আমার আশেপাশে ছিল সবাই মা গোত্রীয়। আমার মা, চাচীরা, ফুপুরা, খালারা ছিল, তার বাইরে ছিলো নানী, দাদি এবং দাদির আম্মা। এছাড়া ছিলো আমার সমবয়সী বা আমার চেয়ে বড় পাড়ার সব মেয়েরা। আমিই ছিলাম আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান, তাই খেলার সাথী ছিলো সমবয়সী পাড়ার সব ছেলেমেয়ে। আমি আর সমবয়সী আজাদ ছাড়া সবাই ছিলো মেয়ে তাই আমাদের খেলাধুলাতে মেয়েদেরই প্রাধান্য ছিলো।
আমরা মেয়েদের সাথে মিলে ছেলেদের গাদন খেলা থেকে শুরু করে মেয়েদের কুতকুত খেলা সবই খেলতাম। আসলে তখনও আমাদের মনে কোনটা ছেলেদের খেলা আর কোনটা মেয়েদের খেলা এমন ধারণা জায়গা করে নিতে পারেনি, তাই ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে আমরা সবাই মিলে যেকোন খেলায় অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে খেলতাম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েদের সাথে থেকে থেকে আমি বেশকিছু কাজ শিখে গিয়েছিলাম সেই ছোট বয়সেই, যেমন মেয়েদের মাথায় তেল দিয়ে দেয়া, উঁকুন বেছে দেয়া, এমনকি মাঝেমধ্যে চুলে সিঁথি কেটে বিনুনি বেঁধে দিতাম। সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেলো যে, একসময় মা, চাচিদের চুল বেঁধে দেয়ার জন্যও আমার ডাক পড়তে শুরু করলো। এছাড়াও মা চাচিদের রান্নার সময় তরকারি কুটে দেয়া, হলুদ মরিচ, বেটে দেয়া পর্যন্ত শিখে ফেললাম।
তবে সবচেয়ে মজা লাগতো ঢেঁকিতে পার দেয়া। অন্য আরো একজনের সাথে মিলে ঢেকিতে পার দেয়া হতো, কারণ আমার ওজন তখন পর্যন্ত ঢেঁকিকে উঁচুতে আনার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। তবে কখনও ঢেঁকির অন্যপ্রান্তে ধান বা চাল নাড়তে দেয়া হতো না কারণ সেটা করতে হয় অত্যন্ত নিপুণ দক্ষতায়। ঢেঁকিটা উপরে উঠে নিচে পড়ার আগেই যে সামান্য সময়ের ব্যবধান, সেই সময়ের মধ্যেই ধান বা চাল নাড়িয়ে দিয়ে হাতটাকে সরিয়ে নিতে হবে। নাহলে ঢেঁকির মুগুরের চাপে হাত ছেঁচে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। আমার বড় ফুপুর একবার এমন একটা দুর্ঘটনায় পরে হাতের বুড়ো আঙুলের মাথা ছেঁচে গিয়েছিলো।
এরপর জীবনের প্রয়োজনে আমরা একসময় শহরতলিতে চলে আসলাম। সেখানেও এক দঙ্গল খেলার সাথী জুটে গেলো, তার মধ্যে ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিলো প্রায় সমান সমান। আমরা যখন দল ভাগ করতাম তখন কে ছেলে আর কে মেয়ে সেটা নিয়ে ভাবতাম না শুধু বয়সের ব্যাপারটা মাথায় রাখা হতো কারণ কোন একজন বয়সে ছোট হলে সে খেলায় পিছিয়ে পড়বে তাই কোন দলে একজন ছোট পরলে সেটাকে সমতায় রাখার জন্য একজন একটু দক্ষ খেলোয়াড় দেয়া হতো।
এভাবেই আমরা পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মিলে আমাদের পাড়ার খোলা জায়গাগুলোতে গাদন খেলা, ছিকে খেলা থেকে শুরু করে ফুটবল ক্রিকেট সবই খেলতাম। আর স্কুল ছুটির সময়গুলোতে রাতের বেলা সবাই মিলে দলবেঁধে খেলা হতো পলানটুক যেটাকে বইয়ের ভাষায় বলে লুকোচুরি খেলা। এই খেলাধুলার সময় মাঝেমধ্যে আমাদের মধ্যে মারামারি লেগে যেতো এবং তখনও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে একদল অন্যদলকে কিল ঘুষি দিতো এবং সেখানেও ছেলেমেয়ের কোন ব্যবধান ছিলো না।
প্রাক প্রাথমিকের পাঠের সময় স্কুলে আমরা বসতাম মাটির মেঝেতে। সবাই মিলে গলার সুর মিলিয়ে পড়তাম অ তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাবো পেরে। প্রাক প্রাথমিক বলতে তখন ছিলো ছোট ওয়ান আর বড় ওয়ান। এরপর দেয়া হতো দ্বিতীয় শ্রেণীর বই। তখন আমরা মেঝে ছেড়ে বেঞ্চে পড়ার সুযোগ পেতাম। হঠাৎ নিজেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো কিন্তু খারাপ লাগতো এইটা ভেবে যে এতদিন পর্যন্ত যাদের সাথে একইসাথে বসেছে তাদের মধ্যে যারা মেয়ে তারা আলাদা সারিতে বসা শুরু করলো। অবশ্য ক্লাশ শেষ করেই আমরা আবার এক হয়ে খেলাধুলা করছি, ঝগড়া করছি মারামারি করছি।
এভাবেই একেবারে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত চললো। ক্লাশে আমরা আলাদা বসলেও খেলার মাঠে আমরা আবার সেই এক।
কলেজে এসে প্রথম ছেলেমেয়ের ব্যবধানটা ভালোমতো টের পেলাম কারণ এতোদিন পাড়ার যে মেয়েরা আমাদের সাথে খেলাধুলা করতো তারা তখন বাড়ির বাইরে আসা মোটামুটি বন্ধ করে দিলো। কলেজে গেলেও কখনও আমাদের সাথে পাড়ার মাঠে আর খেলতে আসতো না। হয়তোবা বাড়ির দেউড়ি থেকে উঁকি দিয়ে দেখতো আর মাঝেমধ্যে ভুল ধরিয়ে দিতো। কলেজেও এক দঙ্গল মেয়ে ছিলো যারা আলাদা সারিতে বসতো।
স্যার যখন ক্লাশে আসতেন তখন তাঁর পিছু পিছু তারা আসতো আবার ক্লাশ শেষ হলে স্যারের পিছু পিছু চলেও যেতো বেশিরভাগই তবে এর ব্যতিক্রমও ছিলো বেশ কজন। মাঝেমধ্যে কলেজের করিডোরে কোন সহপাঠি ছেলে আর মেয়েকে গল্প করতে দেখলে আমরা হা করে তাকিয়ে থাকতাম কারণ মফস্বল থেকে শহরের কলেজে এসে এই দৃশ্যগুলো দেখতে আমাদের চোখ তখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয়তোবা এমন থাকবে না। সেখানে নিশ্চয় ছেলেমেয়ে আলাদা বসবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে আমার ভুলটা ভেঙে গেলো, কারণ সেখানেও মেয়েরা আলাদা সারিতে ক্লাশে বসে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা ছিলো একেবারে হাতে গোনা তাই তারা আলাদা একটা সারির শুরুতে বসতো, তার পিছন থেকে আবার আমরা ছেলেরা বসতাম। এরপর আসলো চাকরী জীবন, সেখানেও মেয়েদের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা এবং তাদেরকে বেছে বেছে এমন কাজ দেয়া হয় যেটাতে শারীরিক পরিশ্রম কম। এরপর একসময় ঘর সংসার শুরু করলে মনের মধ্যে এমন একটা ভাব কাজ করতো যে, আমি কেন বাসার কাজকর্ম করবো সেগুলো করার জন্যতো বউই আছে, কিন্তু আমি বেমালুম ভুলে গেলাম, এই আমি ছোট বেলায় মা চাচিদের তরকারি কুটে দিতাম।
এর বাইরে মেয়েদেরকে দেখেছি গণ পরিবহণে ভোগান্তির শিকার হতে। বাংলাদেশের গণপরিবহণের মানের ব্যাপারে আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই। আমার খুবই রাগ লাগতো যখন দেখতাম ফিটনেসের দোহাই দিয়ে রাতারাতি রাস্তার অর্ধেক বাস আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বন্ধ করে দিতো। যাত্রী তো আর কমে যায়নি, কিন্তু বাস কমে গেছে, তাই ছেলেদেরকেই বসে উঠতে হতো অনেক গায়ের জোর খাটিয়ে, প্রতিযোগিতা করে, সেখানে একজন মেয়ের জন্য বসে উঠা ছিলো অসম্ভব। আর বাসের মধ্যেও ড্রাইভারের পাশে যে হাতেগোণা কয়েকটা সিট বরাদ্দ থাকতো, সেগুলোও দ্রুত ভরে যেতো, তখন বাসের ড্রাইভার, হেলপার আর মহিলা উঠাতে চাইতো না, কারণ মহিলা সিট পূর্ণ হয়ে গেছে।
বাসে উঠা থেকে শুরু করে বাসে বসে বা দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যেকটা ধাপে একজন মেয়ের যৌন হয়রানি হওয়ার সুযোগ থাকে। আমার যেহেতু বোন ছিলো না তাই এই বিষয়টা দেরিতে টের পেয়েছিলাম। একবার আমি আমার এক চাচাতো বোনকে নিয়ে বাসে উঠতে যেয়ে তাকে বললাম, তুমি আগে উঠো, আমি তোমার পিছনে আসছি। এরপর আমার মনে হলো আমার পিছনের সব মানুষ মিলে আমাকে ডিঙিয়ে আমার বোনের শরীর স্পর্শ করতে চাইছে। আমি আমার দুহাত দিয়ে পিছনের সব মানুষকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম, তবুও হয়তো কেউ কেউ সুযোগ নিয়েছিলো। এরপর আমি আর কখনও আমার সেই বোনের সাথে সহজ হতে পারিনি। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতো ছেলেরা কেন এমন অসভ্য, তবে সব ছেলেই কিন্তু অসভ্য নয়, কিন্তু ব্যতিক্রমের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোণা।
বাংলাদেশই মনেহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদের স্পিকার, পুলিশ, প্রশাসনের উঁচু পদের অনেকগুলো দখল করে আছে মেয়েরা, কিন্তু এটা দিয়ে দেশের মেয়েদের সামগ্রিক অবস্থার বিচার করলে আপনি ভুল করবেন। এর বাইরে আবার হাল আমলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মীয় গোড়ামি। এতো কিছু মোকাবিলা করেই প্রান্তিকের একটা মেয়েকে সাফ্যলের চূড়ায় উঠতে হয় এবং আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে তারা সফলও হয়। কিন্তু শহুরে যে শিক্ষিত মেয়েরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি, বাড়িতে এমনকি অফিসে বসবাস করে নারীর সমান অধিকারের জন্য গলা ফাটান, তারা কস্মিনকালেও বুঝবেন না গণ পরিবহনে একটা মেয়ে কী পরিমাণ হেনস্তার শিকার হোন প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।
আমার কথা হচ্ছে কেন আমরা মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই মানুষ হবার শিক্ষা না দিয়ে মেয়ে হবার শিক্ষা দিই এবং তারা যে ছেলেদের তুলনায় শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই আমরা তাদেরকে আলাদাভাবে কখনও বাড়তি আবার কখনও কম সুবিধা দিয়ে তাদের স্বাভাবিক মানসিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্থ করছি। যার ফলে তারা বেড়ে উঠছে একটা নিরাপত্তাহীন জীব হিসেবে। সবশেষে একটা ভালো ছেলের গলায় মালা পরাতে পারাটাকেই তাদের যোগ্যতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ব্যতিক্রম যে নেই সেটা বলছি না কিন্তু এই মানসিকতার পরিবর্তন অতীব জরুরি কারণ বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা হচ্ছে নারী।
তাই নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হওয়া উচিৎ:
“ঘরে বাইরে নারী,
মানুষ হিসেবে সম্মান করি।
পুনশ্চ: আমার এই উপলব্ধিগুলো এসেছে অনেক পরে যখন আমি মেয়ের বাবা হলাম তখন কারণ আমাদের কোন বোন ছিলো না। মেয়েদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে ধরা হয় সন্তান ধরণের ক্ষমতাকে কিন্তু এটা একটা মেয়ের সবচেয়ে শক্তশালী দিকও কারণ তখন সে যেকোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি থাকে। সন্তানের সুখের জন্য একজন মা জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার এবং জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। আমার মনে আছে আমার গিন্নি যখন প্রথমবার গর্ভধারণ করলো তখন সে রাত্রে ঘুমাতে পারতো না। আমি যথাসময়ে ঘুমিয়ে গেছি রাত্রে কোন কারণে ঘুম ভেঙে গেছে উঠে দেখি সে দেয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে বসে আছে কারণ শুইলেই না কি আমার মেয়ে পেটের মধ্যে লাথি দিতে শুরু করে তাই সে বসে বসেই রাত পার করে দিচ্ছে। এরপর থেকেই আমার মাথায় কাজ করা শুরু করলো কিভাবে মেয়েকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা যায় যাতেকরে সে যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।
এছাড়াও বিদেশে আসার পর যখন একসময় গিন্নি কাজ শুরু করলো তখন আমি ঘরের কাজ করতে যেয়ে প্রথমবারের মতো টের পেলাম মেয়েদেরকে সারাদিন কত অনর্থক কাজ করতে হয়ে যেমন ঘর ঝাড়ু দেয়া, কাপড় ধোয়া এবং গোছানো, থালাবাসন ধোয়া এবং গোছানো, চুলা পরিষ্কার করা এগুলো একেবারেই মূল্যহীন কাজ কিন্তু অনেক সময়সাপেক্ষ তাই বাইরের যে কেউ মনে করতে পারে মেয়েরা আসলে বাসায় কিছুই করছে না কিন্তু আসলেই তারা সারাদিন বাসায় এক মুহূর্তের জন্যও বসে নেই। আর যদি বাচ্চাকাচ্চা থাকে তাহলে তো কথায় নেই।
একজন মেয়েকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে শুধুমাত্র একজন ছেলেই, সে হতে পারে তার বাবা, ভাই বা স্বামী আবার কখনও বা ছেলে। তাই রাষ্ট্র, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বা মানবাধিকার সংগঠনের অপেক্ষায় না থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ পরিবারের মেয়েদেরকে সহায়তা করা তাহলেই দেখবেন অবধারিতভাবেই আপনি অন্য মেয়েদেরও সম্মান করতে শুরু করেছেন। আর তখন প্রতিষ্ঠা হবে মেয়েদের সমান অধিকার।
আমি ব্যক্তিগতভাবে যখন গৃহস্থালির কাজে যখন হাত লাগলাম, তখন দেখলাম আসলেই আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিগুলোও কমে এসেছে। গিন্নি, মেয়ে সবার সাথেই সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে, কারণ তারাও বুঝতে পেরেছে যে আমি তাদের কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করতে পেরেছি, তবে এই উপলব্ধিটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল এই সমাজের জন্য, দেশের জন্য এমনকি পৃথিবীর জন্য।