ফাহমিদা নীলা:
-তোমার গায়ে তখন কী ছিল ফুলমনি?
-কী ফের থাকবে বাবু? শাঢ়ি ছিল, শাঢ়ি।
উকিলের জেরার মুখে উত্তরটা দেয়ার পর আরো বেকুব বনে গেল ফুলমনি। এর পরের প্রশ্নগুলো শুনে ফুলমনির রোদে পোড়া মোটা শক্ত টানটান চামড়াটাও কেমন ঝুলে পড়তে লাগলো। যেন কোন লেলিহান শিখার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে আর আগুনের ঝলসানিতে একটু একটু করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে তার শরীরের একের পর এক স্তর।
-শাড়ীটা ঠিক কোথায় ছিল? তোমার গায়ে? গায়ের কোথায়?
-না, খুলে কোতায় বা ফেলে দিছিল ওঁরা।
-তাহলে তোমার গায়ে আর কী ছিল?
-বেলাউজ আর ছায়া।
-ওগুলো কি ছেঁড়া ছিল? না অক্ষত?
-কী বুলিস বাবু? মু মুক্কুসুক্কু মানুষ। ওতো শোতো বুজিনা ক্যানে।
মুর্খ হলেও ফুলমনির মনে হয় উকিলবাবুদের চেয়ে ওর জ্ঞান ঢের ভালো। অন্ততঃ এসব উদ্ভট প্রশ্ন সে কাউকে করতো না কখনো। নিজে নিজেই বুঝে ফেলতো বাকিটা। এ কেমন প্রশ্ন করে বাবুরা?
-ওরা তোমার গায়ের কোথায় হাত দিল প্রথমে?
-হ্যাঁ, তারপর কী করলো?
-কাপড়টা কতখানি উপরে ছিল?
-গায়ে কিছু ছিল? নাকি ছিলই না।
-ডান হাতটা কোথায় ছিল? বাম হাতটা? পা’দুটো?
-তারপর কী করলো?
-তারপর?
একের পর এক তারপরের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে ফুলমনি। সে খেটে খাওয়া মানুষ। কোন ছোটবেলা থেকে কাজ করা শিখেছে মনে নেই। মাঠেঘাটে যখন যেখানে কাজ পেয়েছে, পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। রাস্তা ভরাটের কাজ, মাটি কাটা কাজ, জমির ফসল লাগানো-নিড়ানো-কাটার কাজ। কোনটাতেই পুরুষের চেয়ে কম পারদর্শী সে তো নয়ই,বরং অনেক বাঙালী পুরুষের চেয়ে তার গায়ের শক্তি অনেক বেশি। কাজ দেখে সে ভয় পায় না, তা সে যে কাজই হোক।
সারাবছরই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি একভাবে খেটে যায় সে। ঋতুবদলের হাওয়া তার গায়ে লাগে না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কুয়াশায় স্যাঁতসেতে হয়ে কাজ করতে করতে প্রকৃতির মতো তার শরীরও হয়ে উঠেছে সর্বংসহা। কিন্তু আদালতের বাবুদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তার মনে হচ্ছে, শরীরটা ইস্পাত কঠিন হলেও মনটা ঠিক ততোটাও সহনশীল হয়ে উঠতে পারেনি বোধ হয়। আরো অনেক আগেই তার ইচ্ছে হয়েছে উকিল বাবুকে বলে,
‘ক্যানে, তুঁ তোর ঘরের বহুটার সতে শুতিসনা ক্যানে? তোকোন দেকে লিস, কুন কাপুড় কুতায় থাক্যে আর কুন ওঙ্গো কুতায় রাক্যে?’
নেহায়েতই চেয়ারম্যান বাবু তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছে বলেই না ফুলমনি তাই দাঁতে দাঁত চিপে এতো বড় আদালতে এতোগুলো পুরুষের সামনে তার ইজ্জতহানির ঘটনা বর্ণনা করে যাচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে।
-কতক্ষণ ধরে ছিল ওরা তোমার উপর?
উকিলের জেরার মুখে এবার চুপ করে থাকে ফুলমনি। কতক্ষণ ছিল কে জানে!
ভোরবেলা দুটো পান্তা খেয়ে সেদিন মাঠে নিড়ানি দিতে গেছিল সে। গায়ে তখনও হালকা জ্বর ছিল। সহজে জ্বর ব্যাধি হয়না ফুলমনির। সেইবার কী হলো কে জানে, দুইদিন খুব বাড়াবাড়ি রকমের জ্বর হলো। হাটে গিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দু’পাতা ওষুধ এনেও খেলো। জ্বর একটু কমলো বটে, কিন্তু ছেড়ে গেল না একেবারে। সাথে শরীরটাও একটু দুর্বল লাগছিল। তা ওসব পাত্তা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে তার চলবে কেন? বাড়ির চার চারটে পেট তার একাই চালাতে হয়। বাড়ির মরদটা তো সারাদিন চুয়ানি খেয়ে কোথায় পড়ে থাকে কে জানে! তাকে কিছু বলাও যায় না। সারাজীবন কামাই করে খাওয়াবে, পরাবে এই কথা দিয়ে ফুলমনি তো নিজেই তাকে বিয়ের দিন চালের উপর থেকে নামিয়ে এনেছে। এখন খালি কামাই করা না, রান্না করা, বাড়ি সাফ করা, ছেলেপুলে মানুষ করা সবই ফুলমনির কাজ। মরদের কাজ কেবল খাওয়া আর মাতাল হয়ে পড়ে থাকা।
ফুলমনিকে চুপ থাকতে দেখে উকিল সাহেব আবার একটু ঘুরিয়ে কথা শুরু করে।
-সেদিন তুমি ওখানে গেলে কীভাবে?
-মু মাঠে কাম কোরতে শুরু কোরেছি কেবোলি, উঁ পাড়ার একডা ছুডু চ্যাংড়া মোক ডাক্যে বুললে কী যে, ও ফুলমনি, তোক উঁদিকে একবার ডাকল্যে ক্যানে। মু পুছলাম, ক্যানে? তো উঁ বুললে, দেক না গিয়ে ইয়া বড় বড় ধাড়্যে ইন্দুর ধরেছ্যে। মু খুশি হয়্যে গেনু ক্যানে। দুদিন এমনিই কাম করতে পারিনি। ছোলপুলের প্যাট ভরেনি। একন দুকনা ধাড়্যে ইন্দুর পাল্যে উঁরা কোতো খুশি হোবে। মু কাম ফেলে উঁদিকে আগ্যে গেনু।
-কোন দিকে?
-উঁ উত্তরদিকে একডা ভাঙা পুরান ঘর আচে। বাঙাল ছোলপোল উকানে গিয়ে বিড়ি ফুঁকে। শুনেচি ককোনো ককোনো উঁরা চুরি করে তাড়িমাড়িও খায় মোদের মতো।
-তারপর?
-তারপর মু উঁকানে গিয়ে ঢুঁকতেই উঁরা মোক সবটি মিলে জাপটে ধর্যে ফেললেক।
-কত জন ছিল ওরা?
-হবি গোটা আট-দশেক।
-আটজন না দশজন?
-কী জানি! মু গোনার সমি পাইনি বাবু।
-সবাই মিলে ধরলো একসাথে? না চার-পাঁচজন?
-মু তাও বুলতে পারবো না ক্যানে। খালি মুনে হলো, অনেকগুলো শক্ত হাত মোক জাপটে ধরলেক।
-ঠিক কোথায় কোথায় ধরেছিল?
আবারও চুপ করে গেল ফুলমনি।
-মানে, তোমার শরীরের ঠিক কোথায় কোথায় হাত পড়েছিল ওদের?
-অতো শত জানি না বাবু। ওদের সাথে মোর ধোস্তাধোস্তি হয়েচিল ক্যানে।
-আচ্ছা, কত জনের সাথে তুমি ধস্তাধস্তি করলে?
-এই হোবে ধর গিয়ে চার পাঁচ জন মুতোন।
-তারপর?
-ওরা মোর সতে পারেনি পত্তমে। মু দুইটাকে ঘুষি মেরে নাক ফাট্যিয়ে দিয়েছি ক্যানে!
-তারপর?
-ওরা তো ওনেক আছিল বাবু। দুই কি তিনজন পা ধোরে টান মেরে ধুপ কর্যে মোক ফেলে দিলে মাটিতে।
-তারপর?
-তারপর হামার উপ্রে ঝাঁপিয়ে পোড়লে দুঝনা।
-তোমার হাত তখন কোথায় ছিল?
-উঁরা মোর হাত বেন্ধে ফেল্যেচিলো বাবু।
-তারপর?
-তারপর উঁরা এক এক করে…..
আবার থেমে গেল ফুলমনি। নিজের ইজ্জত খোয়ানোর এমন নিখুঁত বর্ণনা রোজ এসে আদালতে দিতে হবে জানলে সে অনেক আগেই কেস তুলে নিতো। কেস অবশ্য সে করতেই চায়নি। সেদিনের ঘটনার পর অচেতন অবস্থায় কারা যেন হাসপাতালে নিয়ে গেছিল ওকে। ওখান থেকেই কেস হয়ে গেল। তারপর পুলিশ, চেয়ারম্যান, সাংবাদিক সব মিলে বিরাট হাঙ্গামা। চেয়ারম্যান ভালো মানুষ। বলেছিল,
‘ওসব গ্যাঞ্জামে যাস না ফুলমনি। মুই সালিশ করে তোক কিছু পয়সা-কড়ির ব্যবস্থা কর্যে দিমু হিনি!’
সেই বুঝি ভালো ছিল! কিন্তু হাসপাতালের আর কারিতাসের দিদিমনিরা মিলে ফুলমনিকে সাহস দিল। ওকে বোঝালো,
‘টাকা দিয়ে কি ইজ্জতের দাম হয়?’
ঠিকই তো! ফুলমনির মনে হলো, দিদিমনিরা তো ভুল বলেনি। ফুলমনি আদিবাসী বলে তার ইজ্জতের দাম নাই না কি? সে পরিশ্রমী মেয়ে। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করতে করতে সে ভুলেই গেছিল নিজের নারীদেহের সংবেদনশীলতার কথা। নিজেকে আলাদা করে নারী ভাবার অবকাশই বা পেয়েছে কখন! দু’বার বাচ্চা হওয়া আর মাসের দু’তিনটে দিনের বিরক্তি ছাড়া নিজের শরীরে নারীসত্ত্বা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন তার পড়েনি কখনো। এসব তার কাছে দিনে দু’বেলা ভাত খাওয়ার মতোই অতি সাধারণ।
এতোটা দিন সে নিজেকে মানুষ ভেবেছে। হোক না আদিবাসী, কিন্তু মানুষ তো! বারো মাস খেঁটে খাওয়া কর্মঠ একজন মানুষ। কই, যখন মাঠে থাকে, তখন তো পুরুষের চেয়ে কম কাজ কিছু করে না! যখন মাটি কেটে ডালি মাথায় তুলে নিয়ে গিয়ে রাস্তা ভরাট করে, তখন তো পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম কষ্ট হয় না! তবে শুধু তার ইজ্জত খোয়ানোর কাহিনী কেন জনে জনে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে আজ ভরা মজলিসে?
কখনো কখনো ফুলমনির মনে হয়, পুরুষগুলো তার কাহিনী খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শোনার সময় আলাদা পুরুষোচিত আনন্দ পায়। কেমন করে যেন নড়েচড়ে ওঠে। চোখেমুখে এক আদিম লালসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফুলমনির সংরক্ষিত অঙ্গে। ফুলমনির মনে হয় যেন তার ময়লা আধাছেঁড়া কাপড় ভেদ করে ওদের দৃষ্টি চলে যায় একেবারে ওর নারী মাংসের উপরে। আট-দশটা অশিক্ষিত বর্বরের কাছে সে তো ধর্ষিত হয়েছে একবার, কিন্তু এই তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র মানুষদের আদালতে সে মুখের ভাষায়,চোখের চাহনিতে আর বিদ্রুপের হাসিতে ধর্ষিত হচ্ছে বারংবার।
রাগ আর ঘৃণা যেন ছটফটিয়ে দ্বিগবিদিক ছুটোছুটি করে ফুলমনির শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে। একদিকে চেয়ারম্যান আর অন্যদিকে কারিতাসের দিদিমনির চোখের ইশারা উপেক্ষা করে সে বলে উঠে,
‘সব কতা মোক পুছ করছিস ক্যানে বাবু? যারা মোক মিচা কতা বলে ডাক্যে লিয়ে মোর সব্বোনাশটা কললে উঁহাদেরকে ডাক্যে লিয়ে পুছ কর না ক্যানে, ককোন ককোন কোতায় কোতায় কুন হাত, কুন পা দিচিল?’
পুরো আদালত হুট করে নিশ্চুপ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। একেবারে পিনপতন নীরবতা। যেন কোনো কবরস্থান। সবাই আছে, অথচ কেউ নেই। ফুলমনির মনে অনুশোচনা হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। দিদিমনি তাকে বারাবার উত্তেজিত না হয়ে ধীরে-সুস্থে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিল। কিন্তু কাহাতক আর মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায়! এমনিতে হাসপাতালের সাতদিনসহ মোট এক পক্ষ সে কাজ করতে পারেনি। ওর পাড় মাতাল অকর্মণ্য স্বামীটা পর্যন্ত কোদাল হাতে কাজে বেরিয়েছে ক্ষুধার জ্বালায়। এখন যাও বা কাজ শুরু করেছে ফুলমনি, একের পর এক কেসের তারিখ পড়ায় প্রায়দিনই আধাভুখা হয়ে পার করে দিতে হচ্ছে দিন। পেটে দানা নাই, শরীরে ইজ্জত নাই, মুখের শরম দেখিয়ে লাভ কী! আর মানী লোকেরাই যখন ভরা মজলিসে তার মুখ থেকে শরমের রগরগে কাহিনী বের করে তার সম্মান খুবলে খুবলে খাচ্ছে, তখন খামোকা সেটাতে বাঁধ দিয়ে সেই বা মানীর সম্মান নিয়ে ভাববে কেন?
বিচারকের আসনে বসে থাকা তরুণ ভদ্রলোক আদালত কক্ষের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে নিজেই ফুলমনির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
-আচ্ছা, তুমি আমার সাথে কথা বলো মা। ঘটনা কখন ঘটেছিল?
ফুলমনির সারা শরীর তখন রাগে ঘৃণায় অপমানে ফুঁসে আছে। কৃষ্ণবর্ণের মঙ্গোলীয় চেহারাটা কেমন আরো লালচে তামাটে হয়ে উঠেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে সে উত্তর দেয়,
-পন্থাবেলা।
-কখন হয়েছে ঘটনা? ভালো করে বলো মা।
-পন্থাবেলা। পন্থাবেলা।
আবারো ঝাঁঝ ফুটে উঠে ফুলমনির কন্ঠে। জজ সাহেব কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েই আবার প্রশ্ন করেন,
-ঠিক করে সময়টা বলো। ক’টা বাজছিল তখন ঘড়িতে?
ঘড়ি? অতিকষ্টে দমিয়ে রাখা উনুনটা যেন আবার গনগনিয়ে ওঠে। আগুনের ফুলকি ছুটে আসে চোখের কোটর ভেদ করে। জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ক্ষীপ্রকন্ঠে হিসহিসিয়ে ওঠে অশিক্ষিত এক আদিবাসী মেয়ে ফুলমনি।
-এ বাবু,পন্থাবেলা চিনিস না তুঁ, হেকিমীগিরি চুদাছু!