‘পাত্রী’ নয়, মেয়েকে সক্ষম মানুষ হিসেবে তৈরি করুন!

রেজভীনা পারভিন:

মেয়ের জামাইকে মাছের মুড়ো খাওয়ানোর স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে মেয়েকে একজন সক্ষম মানুষ হিসেবে বড় করার স্বপ্ন দেখুন! আমরা মেয়ের অভিভাবকেরা সবসময় এমন স্বপ্ন দেখি যে মেয়েকে পেলেপুষে বড় করে একটা যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো! সেইসাথে মায়েদেরকে বলতে শুনি, মেয়ে বিয়ে দিলে জামাই আদর করতে হবে, ঘরে ভালো জিনিসপত্র রাখতে হবে, নানাপদের পিঠা পুলি বানাতে হবে, মেয়ের বিয়ের সময় গয়না দেবো, খাট পালং দেবো, জামাইকে ঘড়ি দেবো, এখন তো ডায়ামন্ড এর আংটি ছাড়া চলেই না। এবং যথারীতি বিয়ের আসরে আস্ত একটা খাসী নানানভাবে সাজিয়ে না দিলে তো জামাই আদর মনমতো হবেই না।

এখন জামাই আদর যার যার মনমতো করেন, সেটা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই, আমারও মেয়ে আছে, নতুন অতিথির যত্ন করা হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মেয়েটিকে ছোট থেকে বড় করার সময় শুধু কীভাবে বিয়ের যোগ্য ‘পাত্রী’ হওয়া যায় সেইসব কথা না বলে, কীভাবে সে সক্ষম মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে সেইদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

আপনার মনে রাখা দরকার আপনার মেয়ের জন্য খাসী বা মাছের মুড়ো নিয়ে কেউ বসে নেই! বা বউয়ের জন্য ছেলেকে তৈরি হতে হবে, মানিয়ে চলতে হবে, শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে খুশি করে চলতে হবে এই জাতীয় কথাগুলো কিন্তু ছেলেদের মগজে ঢুকিয়ে ছেলেবেলা থেকে বড় করা হয় না। তাই ওদের মগজে এই সামাজিক চাপ নেই, তো, আপনার কন্যা সন্তানটি তো আপনারই সন্তান, তাকে এই সামাজিক চাপ না দিয়ে সক্ষম মানুষ হিসেবে কীভাবে তৈরি হবে, সেদিকে জোর দিন।
কারণ বিয়ে হওয়াটাই একমাত্র কথা নয়।

বিয়ে একটি সামাজিক প্রপঞ্চ। সামাজিক বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের জীবনটাকে চালিয়ে নেবো। তাই বলে বিয়ে নাহলে বা বিয়ে করার পর যদি তার জীবন চালিয়ে নেয়াই কঠিন হয়, সেক্ষেত্রে আলোচনা সাপেক্ষে সেই বিয়েটি বা সংসারটি নাই টিকতে পারে। আসলে বিষয়টি এতো মিন মিন করে বলার কিছু না, পরিস্কার করে বললে বিয়ের পর দিনের পর দিন যদি জীবনের জটিলতা বাড়তেই থাকে, এবং অনেক সময় জীবন বিপন্ন হবার ঝুঁকি চলে আসে, সেখানে কনটিনিউ করে নিজের জীবনটাকে বিষিয়ে তোলার বা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে বলে জীবন দিয়ে দেওয়ারও কিছু নেই! সেটি ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, সবাই সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জীবনটাকে জটিল থেকে সরল করতে পারে বা অনেকে করছেও।

পাঠকরা আমাকে অনেকেই গালমন্দ করবেন এই বলে যে আমি বিয়ের বিপক্ষে কথা বলছি, বা এতো সহজে একটা সম্পর্ক ভাঙার কথা বলছি, এই জায়গায়ই আমার বক্তব্য। সম্পর্ক যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সম্পর্কটা থাকুক বা সবাই সুখে থাকুক, সংসার করুক, এটা আমাদের সবারই কাম্য। কিন্তু যে সম্পর্কের মাঝে আক্ষরিক অর্থে কোোন ’সম্পর্ক’ নেই, সেটা না রেখে জীবনকে গুছিয়ে নেওয়া ভালো।

আমার এক বন্ধুর ডিভোর্স এর কথা শুনে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম, তখন অন্য একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন –“তুমি ওর সংসার ভেঙে গেছে বলে কষ্ট পাচ্ছো, এটা কেন ভাবছো না যে ঐ সংসারটা কনটিনিউ করতে গিয়ে ও কী কষ্ট আর যন্ত্রণা ভোগ করছে!” সত্যিই তখন আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম।

তাই তো, সংসার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যদি সে বেঁচে থেকে প্রতিনিয়ত মৃত্যু যন্ত্রণায় ভোগে, সেটার চেয়ে মুক্তি ভালো। এখন সেই বন্ধু ভালো আছে তার সন্তানকে নিয়ে। সক্ষমতার কোনো বিকল্প নেই, সেই বন্ধুর যোগ্যতা আর দক্ষতার কোন কমতি ছিল না, তাই হয়তো নিজের আর সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা সে দিতে পেরেছে। সক্ষম হলেই আপনার মেয়ের জীবন লালগালিচা বিছানো হবে তা নয়, জীবনকে চালিয়ে নিতে গেলে সক্ষম হতে হবে। বিভিন্ন বহুতল ভবনে যেমন বিপদে বের হবার জন্য একটা বিকল্প সিঁড়ি থাকে, তেমনি প্রতিটা মানুষের জীবনে বিকল্প পথ থাকা জরুরি। তা না হলে জীবন থমকে যাবে, দুঃখ কষ্টের মাঝেই ঘুরপাক খেতে হবে।

আবার মূল জায়গায় আসি, সেদিন ৭ বছরের এক বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের জীবনের টানাপোড়েন দেখে বলেছিল – ‘মা, আমি সব বুঝি, তাই বড় হতে চাই না’, শুনে মায়ের চোখে পানি চলে এসেছিল। মেয়েদের জীবনের জটিলতা দেখে শিশু বয়সেই যে সামাজিক চাপ অনুভব করছে মেয়ে শিশুটি, আমরা তো শিশুটিকে সেই চাপ থেকে মুক্ত করতে পারছি না। তবে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলোকে পরিবর্তন করে একটু একটু করে তৈরি তো হতে পারি! তাই আমি বদলেছি আমার স্বপ্ন, মাছের মুড়ো দিয়ে জামাই আদরের স্বপ্ন না দেখে মেয়েকে সক্ষম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

নৃবিজ্ঞানী
উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.