ফারজানা জহুরা আকসা:
আমার এক বান্ধবী আছে, খুব ভালো চাকরি করে, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। প্রায় দশ বছর হলো প্রেম করে বিয়ে করেছে। এখনো তার শরীরের বা চেহারায় কোনো বয়সের ছাপ পড়েনি। সে নিজের শরীরের ও চেহারা যথেষ্ট যত্ন নেয়। তার স্বাধীন জীবনযাপন, আর ফিটফাট চলাফেরা দেখে আমার মাঝে-মধ্যে ভীষণ হিংসে হয়। মনে মনে ভাবি, সন্তান না নিয়ে সে খুব ভালো করেছে। সন্তান হলে নিশ্চয় তার জীবনটা এতো সুন্দর আর গোছানো হতো না! নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও এতো ব্যস্ত থাকতে পারতো না!
আমার এক ডাক্তার আপু ছিল খুব সুন্দর দেখতে। তিনি সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকতেন। তার বাড়িঘর সবকিছু পরিপাটি ও গোছানো থাকতো। ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি তেমন কোনো চিন্তা করতেন না। নিজের ক্যারিয়ারে শতভাগ সময় দিতে পারতেন। এখন নিজের অগোছালো ঘর গোছাতে গোছাতে তার কথা মনে হয়। ভাবি, তিনি সন্তান না নিয়ে খুব ভালো করেছেন। সন্তান থাকলে তিনি নিশ্চয় এতো শান্তির জীবন পেতেন না! সারাক্ষণ সন্তানের কথা চিন্তা করে, তাদের পিছনে সময় অপচয় করে নিজের ক্যারিয়ারের ঠিক বারোটা বাজিয়ে দিতেন।
সেদিন একজনের লেখা পড়লাম, অসম্ভব সুন্দরী রুপবতী গুণবতী উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী নারী, সন্তানের জন্য বিলাপ করছেন! বহুবার মিসক্যারেজ হয়েছে, তবুও তিনি বার বার সন্তানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন! সন্তান নেই দেখে তিনি লোকসমাজে মিশতে পারেন না, কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না, ব্লা ব্লা ব্লা!
ভীষণ বিরক্ত হলাম লেখাটা পড়ে। এতো এতো যোগ্যতা থাকার পরেও তিনি সন্তান নেই বলে লোকসমাজে মিশতে পারেন না! সত্যি অবাক হওয়ায় কথা। এতো সফল একজন মানুষ সন্তানের জন্য হীনমন্যতায় ভুগবে কেন? সন্তান না হওয়ায় বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিলেই তো হয়! আর তার যা কিছু আছে, তা তো অনেকেরই নেই, তিনি তো ইচ্ছে করলেই সেসব নিয়ে সুখি থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি সমাজের কথা ভেবে যা নেই তা নিয়ে দুঃখ পাচ্ছেন। অথচ তিনি জানেন না যে সমাজের কাজই হলো অন্যের দোষ ধরা। প্রতি পদে পদে যার যেটা নেই, সেটা নিয়ে গালগল্প করা। অন্যকে ছোট দেখিয়ে নিজেকে বড় করা।
আমার মা পাঁচ পাঁচটা সন্তান জন্ম দিয়েছিল, তাও নরমাল ডেলিভারি। তবুও আমার মাকে প্রতিবার সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে সমাজের কথা শুনতে হয়েছে! পরপর মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছিল বলে সবাই ব্যাঙ্গ করে বলতো, তোমার তো শুধু মেয়েই হয়! এর পরে যখন ছেলে হলো তখন বলেছিল, এতো বয়সে আবার বাচ্চা নিলে! ছেলে যখন একটু বড় হলো, তখন সবাই বললো, এমন ছেলে কেন হলো? কার বংশে কী দোষ আছে? আবার আমাকে দেখে বলতো, তোমার এই মেয়েটা এতো কালো কেন? তোমার বংশে কার গায়ের রং এমন? তোমার এই মেয়ের বিয়ে দিবে কীভাবে? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি নিজেও প্রতিদিন হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অনেকেই আমার সন্তানদের নিয়ে নানান মন্তব্য করে। অনেকেই আমার শরীরে নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে গালগল্প করে। প্রতিদিন আমাকেও হাজারও কটূক্তি হজম করতে হয়। মা মাতৃত্বের জন্য প্রতিদিন আমাকে কতটা সংগ্রাম করতে হয়, তা কেউ জানে?
যারা ভাবেন সন্তান হলেই নারীর জীবনটা ধন্য, জীবন পরিপূর্ণ তাদের বোঝা উচিৎ, এই ধন্য আর পরিপূর্ণ জীবন একটা অবান্তর চিন্তা। সন্তান জন্ম দিয়ে কেউ ধন্য হতে পারে না। না সন্তান জন্ম দিয়ে সুখের সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে পারে! মা হওয়ায় একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেই গর্ভধারণ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়, আর কবরে গিয়ে শেষ হয়।
প্রতিটা মুহুর্তে আপনাকে এই মাতৃত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে আপনার সুন্দর টান টান শরীরটা নষ্ট হবে। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আপনার চেহারা খারাপ হবে। আপনি চাইলে যখন যা খুশি তাই করতে পারবেন না। আপনার প্রিয় স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে। আপনার খাওয়া-দাওয়া, গোসল, ঘুম, এমনকি টয়লেটে যাওয়া না যাওয়া সব এই সন্তানের উপরে নির্ভর করবে। তার উপরে সমাজ ও পরিবারের নানা কাজ আর কথার চাপ তো আছেই!
এতো এতো কষ্ট করে যে সন্তানকে একটু বড় করবেন, তখন সমাজের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে আপনার বাচ্চাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে। হয় আপনি এই প্রতিযোগিতা করবেন, নয়তো অন্যরা আপনার সন্তানকে নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। যদি দুর্ভাগ্যবশত যদি আপনার সন্তান অন্যদের মতো মেধাবী বা সুস্থ সবল না হয়, তাহলে সারাজীবন মানুষের নোংরা কটূক্তি কুৎসিত মন্তব্য হজম করে করে সন্তান মানুষ করতে হবে। তখন আপনি চাইলেও সেই সন্তান নিয়ে সুখের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারবেন না। না কেউ আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিবে। আবার কখনো কখনো তিলে তিলে গড়ে তোলা আপনার ক্যারিয়ারের স্বপ্নটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এখন ভাবছেন তো আপনার এসব সমস্যা নেই! আপনার সন্তান হলে হবে পরিপূর্ণ সুস্থ সবল, ফর্সা ও দেখতে টুকটুকে সুন্দর। তাকে লালনপালন ও দেখাশোনার জন্য আপনার পাশে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, কাজের মানুষসহ অনেকেই আছে। আপনার ক্যারিয়ারের কোনো সমস্যা হবে না! আপনি অসম্ভব রুপবতী, সন্তান হলেও সৌন্দর্যচর্চা চালিয়ে যেতে পারবেন! শুধু তাই নয়, সন্তানের জন্য আপনার যথেষ্ট পরিমাণের টাকা-পয়সা, অর্থ সম্পদ আছে। আপনি তার সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। তাহলে খুব ভালো কথা, আপনি সন্তান জন্ম দিয়ে আহ্লাদে আটখানা হতেই পারেন।
কিন্তু যাদের এসব নেই, তারা ঠিকই বুঝতে পারে মা হওয়া শুধুমাত্র সুখের বিষয় না। সারাজীবনের দায় দায়িত্বের ব্যাপার। সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে, তার ভবিষৎ ঠিক করতে গিয়ে নিজের জীবন নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলা। সন্তান জন্ম দিয়ে নারী যেমন মাতৃত্বের সুখ পায়, ঠিক তেমনি এই সুখ তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। তার শরীর ও মনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়।
মাতৃত্ব মানে শুধুমাত্র স্বর্গীয় সুখই নয়, আজীবনের বাড়তি চাপও বটে।