লিপিকা তাপসী:
ধরা যাক কোনো বাবা বলছে, আমার ছেলেটা যৌবনবতী হয়েছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে, কিংবা ছেলেটির বাঁশির মতো নাক, পটল চেরা চোখ’ মেঘের মতো চুল, দুধে আলতা গায়ের রং, এ ধরনের কোন বাক্য দিয়ে ছেলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে।
না, এটি একবারেই ঘটে না; এই কথাগুলো কেউ বাস্তবেও বলে না, কিংবা কোন কবিতা কিংবা কোন গল্পে, সিনেমায়ও ব্যবহার হয় না? আমরা কি কোনো সাহিত্যে কিংবা একজন পুরুষের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে দেখেছি?
এরকম আরও কিছু শব্দ যেমন, মেঘের মতো চুল, লাস্যময়ী, সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, যৌবনবতী, মায়াবিনী, আবেদনময়ী, সুহাসিনী, তিলোত্তমা, সুনয়না, সুহাসিনী, সুকেশিনী, এগুলো পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়? এককথায় না, এগুলো নারীর সৌন্দর্য বর্ণনার জন্যে।
বাংলা একাডেমির বাংলা ডিকশনারির পিতৃতান্ত্রিক লেখকের মতে, নারীর একমাত্র কাজ কারও স্ত্রী হওয়া। আর স্ত্রী হতে গেলে শারীরিক সৌন্দর্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নারীর শরীর বর্ণনার জন্যে এরকম মন ভোলানো শব্দমালা আছে। পিতৃতন্ত্রের আদর্শে বলীয়ান কবি সাহিত্যিকরা নারীর শারীরিক সৌন্দর্য ব্যবহার করতে এসব শব্দ ব্যবহার করেছেন কালে কালে। আবার শারীরিক সৌন্দর্য, পবিত্রতা নষ্ট দেখানোর জন্যে কিছু শব্দ নারীর জন্যে ব্যবহার করা হয়, যেমন, মাগী, খানকী, বেশ্যা, ধর্ষিতা, অসতী, ডাইনী, পতিতা, অলক্ষ্মী, দ্বিচারিণী, ছিনাল, মক্ষিরানী, ছলনাময়ী, ব্যভিচারিণী। কিন্তু কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে বলতে শোনা যায় না অলক্ষ্মী, অসতী, কুলটা খানকী পুরুষ। এগুলোর পুরুষবাচক শব্দ নেই।
বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে নারী শব্দের অর্থ স্ত্রীলোক, রমনী, মহিলা। এখন দেখি স্ত্রী অর্থ কী আছে? স্ত্রী মানে জায়া, পত্নী, বেগম, বিবি, বধু। রমনী অর্থ নারী, সুন্দরী নারী। বেগম অর্থ বিবাহিত মুসলিম মহিলা, মুসলিম নারীর শেষ অংশ, মুসলমান রানী, সম্রাজ্ঞী। পুরুষের অর্থ নর, পুং জাতীয় জীব, মানুষ, মনুষ্য, আত্মা, ঈশ্বর, বংশের ধারা, উত্তম পুরুষ, প্রথম পুরুষ। নারী শব্দের অনেকগুলো অর্থ কিন্তু একটাতেও নারী অর্থ মানুষ, এটি বলা নেই। মানুষ বলতে পুরুষকে বোঝানো হয়েছে। আর সকল অর্থের সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, নারী মানে কারও স্ত্রী। এর বাইরে অর্থাৎ তার বিবাহিত পরিচয়ের বাইরে আর কোনো পরিচয় নেই। একটা রাষ্ট্র তার ভাষার মাধ্যমে নারীর প্রতি কীভাবে বৈষম্য বজায় রেখেছে!
খারাপ শব্দগুলো দিয়ে নারীকে যুগের পর যুগ অপমান, অমর্যাদা করা হয়েছে। নারীকে তার শরীরকে পবিত্র রাখতে, সুন্দর রাখতে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। নারীর জন্যে দুটি টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে; এক, তার শরীরকে পবিত্র রাখতে হবে, আর দুই, তাকে সুন্দর হতে হবে। তাই তাদের আগ্রহ তৈরি হয় বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নয়, বরং শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং তা রক্ষায়। অন্যদিকে পুরুষের জন্য শরীরের পবিত্রতা, অপবিত্রতা, শরীরিক সৌন্দর্য বর্ণনার জন্যে কোন শব্দই তৈরি হয়নি। পুরুষের চারিত্রিক সনদ দেওয়া হয় তার কাজের উপর ভিত্তি করে, বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে, শরীরের উপর ভিত্তি করে নয়। পুরুষের জন্যে বরং আছে বীরপুরুষ, জ্ঞানতাপস, বলবান, শক্তিমান, তেজদীপ্ত এরকম শব্দ।
ভাষা, শব্দ ব্যবহার মানুষের অবস্থান, মর্যাদার প্রকাশ করে। যেমন, বিয়ে করেছি বা বিয়ে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা বলেন ‘বিয়ে হয়েছে’ আর পুরুষরা ‘বিয়ে করেছি’। এই ব্যবহার বলে দেয় কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, কার নেই। আবার প্রবাদ আছে ‘অভাগার গরু মরে, আর সৌভাগ্যবানের গরু’ কিংবা ‘বউ আর ঢোল মাইরের উপর ভালো থাকে’। এগুলো নির্দেশ করে নারীর মর্যাদা, অবস্থান। মানুষ মনে করতে শেখে বউকে পেটানো যায়। শুধু প্রবাদ নয়, বাংলা একাডেমির অভিধান, বাংলা গ্রামার বইয়ে অনেক শব্দ, অর্থ ব্যবহার হয়েছে সেটি বৈষম্যমূলক।
বাংলা গ্রামারে লিঙ্গ পরিবর্তন অংশে পড়ানো হয় পুরুষ লিঙ্গ এর বিপরীত স্ত্রী লিঙ্গ। নারীকে নারীবাচক শব্দ বোঝাতে ব্যবহার করা হয় স্ত্রী লিঙ্গ। এখন স্ত্রী তো একজন নারী তখনই হয় যখন সে কারও সাথে বিয়েতে জড়ায়। যারা বিবাহিত নয় তারা তো কারও স্ত্রী নয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে স্ত্রী লিঙ্গ বা স্ত্রীবাচক কেন হবে? যদি পুরুষবাচক শব্দ বোঝাতে পুরুষলিঙ্গ ব্যবহার করি, তাহলে নারীবাচক শব্দ বোঝাতে নারী লিঙ্গ ব্যবহার করতে ক্ষতি কোথায়? আবার নারী রোগবিষয়ক ডাক্তারকে বলা হয় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, অথচ নারীর শারীরিক অঙ্গপ্রতঙ্গের কারণে বিশেষ রোগে আক্রান্ত হতে কারও স্ত্রী হতে হয় না।
কিছু কাজ নারীও করে পুরুষও করে। যেমন নারী কবি, সাংবাদিক, উকিল, পুলিশ সব পেশায় এখন কাজ করছে। কিন্তু, বাংলা গ্রামার এ এখনও আমরা পড়ে চলেছি ডাক্তার এর নারীবাচক শব্দ মহিলা ডাক্তার। এই শব্দগুলোর লিঙ্গান্তর তো দরকার নেই। কবিতা তো নারীরা লিখলে তার ধরন একরকম, আর পুরুষেরা ভিন্নরকম লেখে এরকম তো নয়, কিংবা নারী সাংবাদিক আর পুরুষ সাংবাদিকদের একই পদে কাজের পার্থক্য তো কিছু নেই।
এখন নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে প্রযোজ্য এমন কিছু শব্দ প্রয়োজন যেটি দিয়ে ঐ ব্যক্তি নারী না পুরুষ তা বোঝানোর দরকার নেই, তার কাজকে বোঝা গেলেই চলে। যেমন নগরপিতা নয় নগরপ্রধান, রাষ্ট্রপতি নয় রাষ্ট্রপ্রধান, সভাপতি নয় সভাপ্রধান, চেয়্যারম্যান নয় চেয়ারপারসন। কারণ শব্দমালা বৈষম্য তৈরি করে মানুষের চিন্তা জগতে। যদি কেউ জেনে বড় হয় একটি পদ শুধু নির্দিষ্ট একটি লিঙ্গের মানুষের জন্যে, তবে তো মানুষের মগজের বৈষম্য দূর করা যাবে না।
একজন মানুষের অনেকগুলো রূপ আছে, যেমন নারী হলো কারও স্ত্রী, কারও মা, বোন, আর পুরুষ কারও বাবা, ভাই, স্বামী। কিন্তু পরিচয়ের ক্ষেত্রে উভয়ই প্রথমত একজন মানুষ। পুরুষের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এটি ঠিক আছে, তাকে বলা হচ্ছে না সে স্বামী, কিন্তু নারীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে তার মুখ্য পরিচয় সে একজন স্ত্রী। এটি বৈষম্যমূলক। এখান থেকেই মানুষের মনে ঢুকে যায় বৈষম্যমূলক অবস্থান। কেউ যদি ছোট থেকে নারী মানুষ নয়, কিংবা পুরুষ মানে প্রথম পুরুষ জেনে বড় হয়, তাহলে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের উপর কর্তৃত্ব করবে, নির্যাতন করবে, অধিকার ফলাবে, এটিই স্বাভাবিক।
একজন নারীকে প্রথমে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেবে এমন শব্দ নির্মাণ করতে হবে এবং এ শব্দগুলো ব্যবহার করতে হবে বেশি বেশি। সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন, শব্দের প্রয়োগ একদিন কাঙ্খিত পরিবর্তন নিয়ে আসবে। নতুন শব্দ সংযোজন নতুনভাবে নির্মাণ করবে নারী পুরুষের মর্যাদা অমর্যাদার বিষয়টি। এজন্যে প্রয়োজন সচেতন হওয়া এবং এর যথাযথ ব্যবহার। পাঠ্য বইয়ে বিশেষ করে বাংলা গ্রামার বই এর এই ধরনের সকল শব্দ পরিবর্তন, ডিকশনারিতে বৈষম্যমূলক শব্দগুলোকে অর্থ পরিবর্তন করে সময়োপযোগী করা প্রয়োজন। এ ধরনের পরিবর্তন করলেই হবে না, এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর এভাবেই বৈষম্য কমিয়ে সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।