সাধু হও, সাধু সাজিও না!

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:

অফিসে প্রায় প্রতিদিনই নিউজ লিখি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন এধরনের নিউজ থাকে ৩ থেকে ৪টা। সারাদেশ থেকে রিপোর্টাররা এসব নিউজ পাঠান অফিসে। যৌতুক, পরকীয়া, দাম্পত্য কলহ, জমি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক কলহ কিংবা তুচ্ছ কারণে স্বামী মেরে ফেলে স্ত্রীকে। এ ধরনের সংবাদ লিখতে লিখতে কখনো গা সয়ে যায়। কখনো খুব মন খারাপ হয়। বেশিরভাগ সময় খুব স্বাভাবিকভাবে কমন ফরমেটে একটা সংবাদ লিখে ছেড়ে দেই। কোথাকার কোন গ্রামের বউকে যৌতুকের জন্য স্বামী গলা কেটে মেরে ফেললো, কিংবা শহুরে কোনো শিক্ষিত নারীকে পরকীয়ায় বাধা দেয়ায় গলা টিপে হত্যা করলো স্বামী, বা চোখে মুখে এসিড ঢেলে দিলো, কেইবা তার খবর রাখে। দুই তিন দিন উহু আহা করা হয়। চলে প্রতিবাদ, তারপর সেই সুখে শান্তিতে বসবাসের মতো।

কোনো নিউজে আবার সত্যিই খুব চমকে ওঠি। খুব কান্না পায় কোনো কোনো হত্যার নৃশংসতা দেখে। ভিডিও ফুটেজ দেখলে মন খারাপ থাকে ৫দিন। তারপর আবার ভুলে যাই নতুন কোনো হত্যার সংবাদে।
এর মাঝে মাঝে কখনো কখনো নিউজ আসে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। এর কারণও বেশির ভাগই দেখা যায় পরকীয়া আর দাম্পত্য কলহ। এধরনের নিউজ এলে কখনো কখনো অফিসে কিংবা আডডায় চলে টিটকারির হাসি। কোনো কোনো পুরুষ সহকর্মী বা বন্ধু ভয়ের ভান করে বলেন, বউকে বেশি কিছু বলা যাবে না। তাহলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।
মাঝে মাঝে তাদের অনেকের এধরনের কথায় অবাক হই। যখন একজন স্বামী স্ত্রীকে মেরে ফেলছে তখন তা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি আমরা। কিন্তু স্ত্রী মেরে ফেলছে শুনলে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠছি।

হায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! আমরা ভুলে যাচ্ছি অপরাধ সবসময়ই অপরাধ। সেটা নারী করলেও অপরাধ। পুরুষ করলেও অপরাধ। অপরাধের কোনো জেন্ডার নেই। শ্রেণি বৈষম্য নেই। থাকা উচিতও না।

কদিন থেকে মিতুর পরকিয়া নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে। তুমুল ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে। যেন এদেশে মিতুই একা পরকীয়া করেছে। বেশিরভাগ পুরুষরা সব সাধু। তারা পরকীয়া কী, জানেই না! তারা কোনো অন্যায় করেই না। পুলিশও খুব একটিভ। দ্রুত গ্রেফতারও করে ফেললো মিতুকে। ছবিও ছাপা হলো তার। মিতুর গ্রেফতারে আমার আপত্তি নেই। আইন বুঝবে কী করতে হবে। আমার আপত্তি মিতুর বিরুদ্ধে পুরুষদের সোচ্চার হওয়া দেখে। তাদের তো দেখি না পুরুষদের অপরাধের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতে, বা গলা ফাটিয়ে কথা বলতে? তারা কেন সোচ্চার হোন না তাদের অপরাধের বিরুদ্ধে? পুরুষকরা কি কখনো রুবি জলি, জরিনা, রাবেয়া, সুমি, সীমাকে মেরে ফেলার জন্য আহাজারী করেছেন? করেননি। দিনের পর দিন যখন স্বামীরা তাদের বউয়ের সাথে প্রতারণা করেন। স্ত্রী যখন অসহায় হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে যান, তখন তার জন্য কি চোখের পানি ফেলেছেন? না ফেলেননি। কারণ তারা তো মেয়ে। তাদের মুখ বুঁজে সব সহ্য করে যেতে হবে। স্বামীরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। তাদের সে স্বাধীনতা আছে। দিনের পর দিন কত পরকীয়ায় বাঁধা দেয়ায় কত মেয়েকে যে স্বামীর হাতে মরতে হয়েছে, কিংবা মরতে হচ্ছে প্রতিদিন! কয়টা স্বামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ? এখন পর্যন্ত কয়জন অভিযুক্ত স্বামীর বিচার হয়েছে?

অনেকেই আজ ডা.আকাশের জন্য হা হুতাশ করছেন। আমার নিজেরও খারাপ লেগেছে। প্রতারণায় আকাশের যে কষ্ট হয়েছে। মন কুঁকড়ে গেছে। তা সত্যিই কেউ চায় না। যারা প্রতারণা করেন, তারা কখনো জানতে চান না তাদের আচরণের ফলে তার নির্দোষ স্ত্রী বা নির্দোষ স্বামীর মন কেমন ছোট হয়ে হয়ে যায়! কেমন করে মন মরে যায় প্রিয় স্বজনের। কোটি টাকা পেলেও সেই সুখ আর ফিরে আসে না সেই মনে।

প্রতারণায় ঘরে ঘরে কত জুঁথি বেলী রুমা আসাদ রোমেলরা কাঁদছে, কে জানে তা! আকাশ লিখেছে, ভালো না বাসলে ছেড়ে দিন। প্রতারণা করবেন না। সত্যিই তাই। নারী পুরুষ যেই যে সম্পর্কে জড়ান, দয়া করে প্রতারণা বা বিশ্বাস নষ্ট করবেন না। কিন্তু তারা সেই কাজটিই করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর সংসার করার পর স্ত্রী যখন জানতে পারেন তার স্বামীর অন্য জায়গায় সংসার আছে। সন্তানও আছে সেখানে। তখন তার মাথায় গোটা আকাশ কি ভেঙ্গে পড়ে না?

আবার কোনো স্বামী যখন জানতে পারেন, তার স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে চলে গেছে তারই প্রিয় বন্ধুর কাছে। তখন তার মনের অবস্থা কী হয়, এ সমাজ দেখে? দেখে না। এ সমাজ পুরুষদের প্রতারণাকে সহজভাবে নেয়। তাই তারা বাইরে কোনো অনৈতিক সর্ম্পক করে যখন ঝামেলায় পড়েন, তখন তিনি সুবোধ বালকের মতো আবার ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। স্ত্রীর কাছে। সমাজের চাপে স্ত্রী সন্তানরা হয়তো মেনে নেয় তাকে। তবে মনে হয়তো নেয় না।

আর নারীদের বিষয় জানাজানি হলে তারা হয়ে যায় ডাইনী, শয়তান, রাক্ষুসী। তাদের স্বামী কিংবা বাবার বাড়ি কোনটাতেই আর ফিরে যাওয়ার জায়গা থাকে না। বাধ্য হয়ে অনেক মেয়েই তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কারণ অনেক মেয়েরই নেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা। ফলে মার খেয়ে অত্যাচার সহ্য করে তাকে সয়ে যেতে হয়। নয়তো কখনো তাকে জড় পদার্থের মতো থাকতে হয় সংসারে। প্রতিবাদী হলেই গলাটিপে মরতে হবে যে তাকে।

অনেক পুরুষের লেখায় পড়লাম আকাশকে নিয়ে আহাজারি। ফেসবুকে মিতু তার বন্ধুদের সাথে ছবি দেয়ায় তাকে ডাইনীসহ নানা ভূষণে ভূষিতও করছেন কেউ কেউ।

সুপ্রিয় পাঠক নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন। কখনো কি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার বা হোয়াটসআপে বউকে লুকিয়ে অন্য মেয়ের সাথে চ্যাটিং করেননি কেউ (সবাই না)? কোন না কোনোভাবে অনেকেই (সবাই না) বাজেভাবে নক করেছেন অনেক নারীকে। স্বীকার করুন বা না করুন। তখন আপনার বিবেক কোথায় থাকে? নাকি আপনি পুরুষ বলে যা ইচ্ছে তা করার অধিকার আপনার আছে!

ফেসবুকে পরিবারের সাথে হাসি মুখে ছবি আপলোড করে পরক্ষণেই গভীর রাতে সহকর্মী বা পরিচিতদের নক করেছেন অনেকেই। গল্পে-আডডায় সেগুলো কিন্তু ঠিকই বলে নারীরা। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন। আকাশ মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। মিতুর উচিত ছিলো স্বামীর পাশে দাঁড়ানো। তাকে ভালবাসা সহমর্মিতা দিয়ে সুস্থ করে তোলা। তার সন্দেহ দূর করা। যেমন অনেক সুমন রবি জাহিদেরও উচিত তাদের বউরা তাদের সন্দেহ করলে তাদের পাশে থাকা মানসিক যন্ত্রণার সময়। মেয়েরা অপরাধ করলে দোষ। আর ছেলেরা অপরাধ করলে সাত খুন মাফ, তা তো হতে পারে না। একই সমাজে কেন হবে দু রকম নীতি?

অপরাধ অপরাধই। তাই আমরা চাইনা ঘরে ঘরে নারী বা পুরুষরা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদুক তার প্রিয় স্বজনের প্রতারণায়। সাময়িক মোহের ফলে যে ভুল করা হয়, তার জের টানতে হয় পুরো জীবন ধরে। আর এর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তাই ভাবুন আপনার সন্তানদের কথা। তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা। আপনার/আপনাদের অপরাধের কারণে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। স্বজনদের কাছে শ্রদ্ধা না পেয়ে সারাজীবন ভর ঘৃণা পাওয়া কি খুব সুখকর?
ভেবে দেখবেন যারা এখনো প্রতারণা করে যাচ্ছেন পরিবারের সাথে, তারা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.