অনন্যা নন্দী:
ছোটবেলায় পুতুল বিয়ে দেয়ার সময় খুব চেষ্টা করতাম, যে বান্ধবীর পুতুল বাক্সে সবচেয়ে বেশি শাড়ি থাকতো, যেন তার ছেলে পুতুলের সাথে আমার মেয়ে পুতুলটার বিয়ে দিতে পারি। আরেকটু বড় হওয়ার পর বুঝলাম বিয়ে ব্যাপারটা আসলেই তাই।
যে ছেলের মানিব্যাগ ভর্তি টাকা থাকবে, সে দেখতে যেমনই হোক, কিংবা আচার-ব্যবহার যদি গাড়লের মতোও হয়, সেই ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলেই মা-বাবারা যেন বাঁচে। খুব কমসংখ্যক পরিবার আছে যারা ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা মানসিকভাবে সে কতটা উদার, তা যাচাই করে মেয়ে বিয়ে দেয়।
আবার ছেলেপক্ষকেও অতোটা ইনোসেন্ট ভাবার কোনো কারণ নেই। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত যাচাই করে তবেই “মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে” এই কাঙ্খিত বাক্যটি শোনা যায়। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে।
এখন লাভ ম্যারেজের যুগ। তবে লাভও আজকাল পোলাপাইন বুঝে শুনেই করে। ছেলেরা ভাবে, মেয়েটাকে নিয়ে প্রোফাইল পিকচার দিলে আমার বন্ধুরা জ্বলবে তো! মেয়ের প্রোফাইলে ছেলেরা বেশি কমেন্ট করলে তো হয়ে গেলো সেই মেয়ে চরিত্রহীনা, মেয়ে বেশি ঘুরে-বেড়ানোর ছবি দিলে মেয়ের সংসারী না ইত্যাদি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না।
আবার মেয়েরাও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। মেয়েরাও বাইক, ডিএসএলআর, ভাল মাইনের চাকরি কিংবা বিদেশি ডিগ্রি আছে, এমন ছেলে পেলে একেবারে বাঁদর ঝোলা হয়ে ঝুলে পড়ে। ছেলেটা মানুষ হিসেবে কেমন সেটা ইম্পরট্যান্ট না, বিদেশে হানিমুনে গিয়ে প্রোফাইল পিকচার দেয়াটা ইম্পরট্যান্ট।
মেয়েটার চরিত্রের চাইতে মেয়ের বাবা কত টাকা যৌতুক দিতে পারছে, কিংবা মেয়েটাকে বিয়ে করলে বন্ধুমহলে স্ট্যাটাস কতোটা আপগ্রেড হচ্ছে, সেটা ইম্পরট্যান্ট। কিছুদিন আগে আমার এক কাজিনের বিয়ে হয়েছে। জামাইবাবু অস্ট্রেলিয়া থাকে। আমার কাজিনকে জাস্ট জিগ্যেস করলাম, “তোকে অস্ট্রেলিয়া কখন নিয়ে যাচ্ছে”-
সে উত্তর দিলো, “আমি এতো কাঁচা কাজ করিনি, আগে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা কনফার্ম করেছি, তারপর বাবাকে বলেছি আয়োজন করতে।” কথাটা শুনে তার দাম্পত্য বন্ধন, ভালোবাসার চাইতে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল হওয়ার উপর যে বেশি নির্ভরশীল তা বুঝতে কষ্ট হয়নি।
বিয়ে নামক চুক্তিতে এখন সবচেয়ে উপেক্ষিত শর্ত হলো, “সুখে থাকা”।
ছেলেপক্ষ, মেয়েপক্ষ সবাই পাত্র-পাত্রীর এডুকেশন, ইউনিভার্সিটি, চাকরি, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, দেনমোহর, বিয়ের বরযাত্রী ইত্যাদি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে দু’জন নরনারীকে একসাথে থাকার অনুমতি দেয়। একসাথে থাকতে গিয়ে তারা একে-অপরের চুল ছিঁড়লো, কী ঠ্যাং ভাঙ্গলো তা জরুরি না। কারণ সোশ্যাল স্ট্যাটাস ধরে রাখতে হবে তো।
এজন্যই তো বিয়ের পর হাজারটা ঝামেলা হলেও সোশ্যাল স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে যাবে বলে ডিভোর্সের চাইতে আত্মহত্যাকে সহজ মনে হয়। যদি “সুখী” হওয়াটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিয়েগুলো হতো, তাহলে বিয়ে ভাঙার পর এতোকিছু ভাবতে হতো না। একবাক্যে বলে দেয়া যেত, “আমরা একে অপরের সাথে সুখে নেই, তাই আমরা আর একসাথে নেই।”
আইনজীবী
চট্টগ্রাম জজ কোর্ট