ডা. ফাহমিদা নীলা:
আমাদের দুদক হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে ডাক্তারদের উপস্থিতির ব্যাপারে যে রিপোর্ট করেছে, তা নিয়ে কোন কথা বলবো না। ওটা নিয়ে যথেষ্ট কথা বলা হয়ে গেছে। এবং সেটা নিয়ে যারা লাফালাফি করেছে তারা যে হিসাবে কাঁচা তা নতুন করে বলার কিছু নাই। সরকার নিয়ম করুক, ডাক্তাররা রোস্টার ডিউটি বাদ দিয়ে কেবল আট ঘন্টা ডিউটি করবে, দুদক কেন দুদকের বড় কুটুম্বরাও আমাদের শতভাগ উপস্থিতি দেখতে পাবেন।
আমার প্রসঙ্গ এটা না। আমার প্রসঙ্গ হলো, এই যে দুদক চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপারে এতো তৎপর হলেন, এনারা কি দেশের যত্রতত্র যে অপচিকিৎসা চলছে, তা দেখতে পাচ্ছেন না? পল্লী চিকিৎসক তৈরির নামে দেশে যে কতগুলো মরণফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে ওনারা অবগত নন?

একখান ছোট্ট উদাহরণ দিই শোনেন। একদিন আমার বস কিছু খাতা দেখতে বললেন। আমাদের স্বাস্থ্যতে কমিউনিটি লেভেলের একেবারে নিম্নস্তরের এক শ্রেণীর কর্মচারীদের ইভালুয়েসন খাতা। প্রশ্ন লেখা আছে, ইনসুলিন কি? উত্তর দিয়েছে,ডায়াবেটিসের ইঞ্জেকশন। হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। ঘটনা হল,এনারাই আবার নিজের নামের সামনে বিরাট করে ডাঃ লিখে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ধুরন্ধুম প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন। এটা দুদকের চোখে পড়ে না? দেশে যে এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রী ব্যতীত অন্য কেউ ডাক্তারী প্র্যাকটিস করতে পারবেনা, এই মর্মে আইন আছে এটা দুদক জানেন না?
একজন ডাক্তারের ৮০% ইফোর্ট নষ্ট করে দিচ্ছে এই সকল পল্লী চিকিৎসক। উদাহরণ চান। দিচ্ছি। ভাল করে পড়ে দেখুন,জেনে রাখুন,মনেও রাখুন। হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। ভাল করে খেয়াল করুন।
(১) আপনার হাই ব্লাড প্রেসার। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছে। আপনি মোড়ের ওষুধের দোকানে বসা পল্লী চিকিৎসককে প্রেসার দেখালেন। উনি বিজ্ঞের মত বললেন, আরে আপনার প্রেসার তো নরমাল। কে আপনাকে প্রেসারের ওষুধ দিল? আজ থেকেই ওষুধ বন্ধ করে দেন।
ফলাফলঃ কথায় বলে,বেকুবের পাল্লায় পড়ে সবাই বেকুব হয়ে যায়। একবারও আপনি চিন্তা করলেন না, যে ওষুধ খেয়ে আপনার প্রেসার নরমাল হয়েছে সেটা বন্ধ করলে কি হবে? কি হবে বুঝতে পারছেন না? প্রেসার আবার আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। আপনার আনকন্ট্রোল্ড প্রেসারের জন্য স্ট্রোক হবে,হার্টের প্রবলেম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্ষতি কার হল? আপনার। দোষ কার হল? পল্লী চিকিৎসককে কিন্তু আপনি একবারও দোষাবেন না। ওই যে যিনি প্রথমে আপনার প্রেসার নরমাল করার ওষুধ দিয়েছিল তেনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবেন আপনি এবং আপনার চৌদ্দগুষ্টি।
(২) ডাক্তার গর্ভবতীদের বলে দিচ্ছেন, আপনারা প্লিজ বাড়ীতে ডেলিভেরী করাবেন না। ওই যে গ্রামের বড় বড় পল্লী চিকিৎসক আর দাই বসে আছেন, তারা বলছেন, আরে ডাক্তাররা ওগুলা বলবেই। হাসপাতালে গেলেই তোমার পেট কেটে দিবে। বাড়ীতেই ডেলিভারি করাও। কিচ্ছু হবেনা।
ফলাফল, মাতৃমৃত্যুর হার যেভাবে কমার কথা ছিল তা কমছে না। একটা লেভেলে এসে আটকে গেছে। একই ঘটনা ঘটছে শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রেও। সূচকের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী হচ্ছে কে? কে আবার! ডাক্তার। পল্লী চিকিৎসক না কিন্তু।
(৩) ডাক্তার বলে দিচ্ছেন, আপনার ডায়াবেটিস আছে ওষুধ খান, হাঁটেন। নিয়মিত চেকআপে আসেন। পল্লী চিকিৎসক বলে দিচ্ছে, অতো ওষুধ খাওয়া লাগবি লয়। খালি এনা খাওয়া কন্ট্রোল করো, আর হাঁটাহাঁটি তো হয়ই। বসে থাক্যে তো আর খাও না! ওতিই হবি। অতো ডাক্তরের গোড়ত যাওয়ার কাম নাই। হামরা তো আছিই। ডাক্তারগেরে খালি ট্যাকা লেয়ার ধান্দা! বুজো না?
ফলাফল, ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের বাইরে। শরীরে কোন ঘা ভালো হয় না। চোখ নষ্ট, কিডনী নষ্ট, মাথাও নষ্ট।
(৪) রোগীর ইনফেকশন। ডাক্তার এন্টিবায়োটিক দিচ্ছেন সাত থেকে পনেরো দিন। পল্লী চিকিৎসক বলছে, খাইছো না দুই দিন। আরাম পাইছো তো! আর খাওয়া লাগবে না। এন্টিবায়োটিকের দাম বেশি। ডাক্তাররা ইচ্ছা করে বেশি বেশি লেখে দেয়। বুঝলা না, ওষুধ কোম্পানির কাছে টাকা খাওয়ার ধান্ধা।
ফলাফল, এন্টিবায়োটিক রেজিন্ট্যান্স হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব শুধু একজনের উপরে নয়, পুরো কমিউনিটিতে পড়ছে। জীবাণুরা আপনার আমার মত হিংসুক না। তারা যে ওষুধে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেটার বিরুদ্ধে শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলছে যেন পরবর্তীতে ওই ওষুধ তাদের আক্রমণ করতে না পারে। আর এই কাজটা তারা একা করছে না, পুরো এলাকা জুড়ে ওদের সব জাত ভাইকেও একই দুর্ভেদ্য প্রাচীরে সুরক্ষিত করে দিচ্ছে। ফলে ওই এলাকায় ওই নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। কিছু মানুষের ভুলের জন্য ভুগবে পুরো এলাকাবাসী।
(৫) রোগীর ফোঁড়া হয়েছে। আপনি কেটে পূজ ড্রেইন করে এন্টিবায়োটিক দিতে চাইলেন। পল্লী চিকিৎসক পরামর্শ দিল,আরে কাটাকাটি করা লাগবে না। হামি ওষুধ দিচ্ছি,ভাল হয়া যাবি।
ফলাফল, হয় পূজ জমে শক্ত টিউমারের আকার ধারণ করবে যেটাকে আমরা এন্টিবায়োমা বলি। অথবা ফেটে গিয়ে খানিক পূজ বের হয়ে আবার মুখ বন্ধ হয়ে পূজ জমা হতে থাকবে। ফিস্টুলাও হয়ে যেতে পারে।
(৬) রোগীর অতিরিক্ত রক্তস্রাব হচ্ছে। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছেন একটানা একুশ দিন। পল্লী চিকিৎসক বলছে, তিন দিন খাত্যেই তো তোমার রক্ত বন্ধ হয়া গেছে। এখন ওষদ বন্ধ করে দ্যাও।
ফলাফল, পুনরায় রক্তক্ষরণ শুরু। আবারও পল্লী চিকিৎসক তিন দিন ওষুধ খাইয়ে ওষুধ বন্ধ করে দিবে। এভাবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকবে। রোগী রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসে অভিযোগ করবে, কি ওষদ নেকে দিলা ম্যাডাম,অক্ত কোমা আয়িছেই। খাল্যে ভাল থাকি,বন্দ করল্যেই বেশি।
(৭) ডাক্তার রোগী দেখে বলছে, এটাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নাই। পল্লী চিকিৎসক রোগীর আড়ালে তার আত্মীয়ের পরিচয় দিয়ে জোর করছে, স্যার আপনি প্লিজ পুরা বডি চেকআপ করার ব্যবস্থা করে দেন। ওনারা দেখতে চান।
ফলাফল, রোগীর বাড়তি পয়সা খরচ। মাঝখান থেকে ডাক্তারের নামে অপবাদ, খামাকা টেস্ট দেয়।
এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। রোগীরা রোগ হলে প্রথমেই মোড়ের দোকানদার যারা এলাকায় ডাক্তার নামে খ্যাত, কিংবা পাড়ার পল্লী চিকিৎসক যে অবশ্যম্ভাবীভাবেই ডাক্তার নামে খ্যাত, তার কাছে ঘোরাঘুরি করছেন বেশ কিছুদিন। এরা না পারলে শেষে রোগীর আত্মীয় সেজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসছে রোগীকে। সাথে যাওয়া-আসার জন্য মোটা অংকের মাসোহারাও নিচ্ছে রোগীর কাছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ইনভেস্টিগেশন বাবদ মোটা অংকের পার্সেনটেজ খাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ডাক্তারের দেয়া এই ব্যবস্থাপত্র ফলো করে পরে অন্য রোগীর উপর প্রয়োগ করছে। এই যেমন, রোগীর সিস্টের জন্য রক্ত যাচ্ছিল বলে আপনি ওষুধ দিয়েছেন, ওই বেটা গর্ভপাতের জন্য রক্ত গেলেও ওই একই ওষুধ দিবে। কিংবা ভাইস ভারসা।
এইসবে একদিকে ডাক্তার উপাধিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ডাক্তারী পেশার সাড়ে তেরোটা বাজিয়ে এবার চৌদ্দর দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এরা। আর এসবের সাথে সাধারণ মানুষ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলি। একদিকে যেমন মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, অন্যদিকে আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাঙালী অবশ্য জাতিটাই এমন, সামনে দিয়ে সূঁচ যেতে দেয় না, পেছন দিয়ে বাঁশ চলে যায়। বড় ডাক্তারের কাছে গেলে বা হাসপাতালে গেলে দু’আনা বেশি খরচ হবে বলে যে পল্লী চিকিৎসকের দুয়ারে ধর্না দিচ্ছেন, আখেরে তার কিন্তু দুয়ের জায়গায় শুধু চার না, আট আনা, এমনকি ষোল আনাও গচ্চা চলে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে রোগীর মরবিডিটি, ক্ষেত্রবিশেষে মরটালিটি রেট বাড়ছে। আছে এসব তথ্য দুদকের কাছে?
আমি নিজের কথা বলি।
প্রাইভেট চেম্বারে যে চিকিৎসা দিতাম, সরকারি হাসপাতালেও একই চিকিৎসা দিতাম। একইভাবে সময় নিয়ে উপদেশ লিখতাম। বাড়ী ফেরার সময় দেখি, সব প্রেসক্রিপশন হাসপাতালের গেটে পায়ের নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পরবর্তী ভিজিটে কেউ আগের প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে না। হাসপাতালের সাপ্লাই বাদে আরো বাইরের যে ওষুধ লেখা হয়, খায় না। অথচ, সে ঠিকই ওষুধের দোকানদারের থেকে বিনা প্রেসক্রিপশনের ওষুধ নিয়ে খাচ্ছে অনিয়ম করে। ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে, আশা করি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে হবেনা। অনেক বলে, বুঝিয়েও কাজ হয় না দেখে এখন ধমকের সুরে বলে দিই, পরেরবার এই প্রেসক্রিপশন না আনলে চিকিৎসা দিব না। কর্কশ কথায় কিঞ্চিৎ হলেও কাজ হয়েছে। বাঙালী সোজা কথার মানুষ না। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ মুখ ঝামটিয়ে বলে, ‘তুমি চিকিৎসা না দিলে হামার ঠেকা পড়বি! তুমি ছাড়া আর ডাক্তর নাই মুনে হচ্ছে!’ আছেন আমার বারিস্টারের মতো তেনাদেরও আছেন পল্লী চিকিৎসক।
কিছুদিন আগে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে অরাজকতা নিয়ে লিখেছিলাম। ডাক্তাররা পড়ে মনে মনে বাহবা দিলেও লাইক-কমেন্ট দেয়ার সাহস পাননি বেশীরভাগই আর নন ডাক্তাররা পড়ে মজা নিয়েছেন। ট্যাকা কামাবু, প্যারা খাবু না, তাই কি হয়! আমি বাঙালীদের কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই। যে বন্ধুটি সময়-অসময়ে বিরক্ত করে বিনা পয়সায় উপদেশ নেয়, সুযোগ পেলে সেই বাঁশ দেয় সবার আগে।
সে যাকগে, স্বভাব যায় না মল্যে! কাজের কথা বলি। দেশের ডাক্তারদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন পেতে হলে সবার প্রথমে মাঠে-ঘাটে-রাস্তায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা পল্লী চিকিৎসকের আস্তানা বন্ধ করুন। ঔষধের দোকানদারদের অযথা প্রেসক্রিপশনের উপর মোড়লগিরি ফলানো বন্ধ করুন। যখন দেশে এমবিবিএস ডাক্তারের অভাব ছিল, তখন পল্লী চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, ভাল কথা। এখন দেশের আনাচেকানাচে কোয়ালিফাইড ডাক্তার আছে। এখন কেন অযথা এই কোয়াক ব্যবস্থা চালু থাকবে? কেন এটা সরকার দেখবে না? দুদক কেন দেখবে না? গ্রামেগঞ্জে একটা নবীন ডাক্তার পোস্টিং নিয়ে গিয়ে ওদের জন্য ঠিকমতো রোগী দেখতে পারেনা, এটা জানেন আপনারা? শত অব্যবস্থার মধ্যে যখন একজন ডাক্তার চাকুরী করেন, তখন কেবলমাত্র এইসকল ব্যাঙের ছাতার জন্য তাকে কতোটা হেনস্তার শিকার হতে হয়, সেটা বোঝেন আপনারা? প্রায়শঃই এদের অকাজ-কুকাজের দায় এসে পড়ে ডাক্তার সম্প্রদায়ের ঘাড়ে। পত্রিকায় পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে, ‘অমুক এলাকার অমুক ডাক্তার কর্তৃক খুন/ধর্ষন……’! ডাক্তারের আগে পল্লী শব্দটা লিখতে তেনাদের শরম লাগে।
এভাবে চিকিৎসকদের পিছে অযথা উদ্দেশ্যমূলকভাবে লেগে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন,আসলেই বোধগম্য না। মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন, সেগুলো সমাধান করুন। তারপর,হ্যাঁ তার-পর,ঢালাওভাবে দেশের চিকিৎসক সমাজের দিকে আঙ্গুল তুলুন। তা না হলে, কিছুদিন পর নিজেরাই বুঝবেন, উপর দিকে মুখ করে থুতু ছিটাচ্ছেন আপনারা। সেই থুতু নিজের গায়ে মাখার জন্য প্রস্তুত আছেন তো!