বিকাশ মজুমদার:
মানুষের গায়ের ত্বকের রঙের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে মাল্টি মিলিয়ন ডলারের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের রমরমা ব্যবসা এবং আগ্রাসী বাজার ব্যবস্থা। গায়ের রঙ নিয়ে ব্যবসার ভয়াবহ দিক এবং কীভাবে এই ভয়াবহতা বন্ধ করা করা যায়, সে বিষয়ে মেরি রোজ আব্রাহাম সম্প্রতি ভারতের ভোক্তা বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সাথে কথা বলেছেন।
কবিতা ইমানুয়েল বলেন, কালো জগতের আলো, তবে এই আন্দোলন বর্ণবাদী বা ফর্সা ত্বকের বিরুদ্ধে নয়। বরং গায়ের রঙ যখন সৌন্দর্য নির্ধারণ করে দেয় তখন বাজারি ধারণাকে প্রতিরোধ করা দায়িত্ব হয়ে যায়। কালো জগতের আলো আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন তারকা শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। তিনি এই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষকে তাদের গায়ের রঙের কারণে বৈষম্যের কাহিনী সবাইকে জানানোর আহ্বান জানান।
আন্দোলনটি গণমাধ্যমে সচেতন করার জন্য কর্মশালার আয়োজন করে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে প্রস্তাব রাখেন গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য নিরসনের কার্যক্রম শুরু করার তাগিদ দেয়। ইমানুয়েল বলেন, গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও দেখা যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল ত্বকের শিশুকে বলা হচ্ছে ‘সুন্দর’ পক্ষান্তরে একটা কালো শিশুর কপালে জুটে গেল ‘কুৎসিত’ তকমা।
পাঠ্যপুস্তকে এহেন বৈষম্যের কারণে কিছু শিশু গভীরভাবে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ইমানুয়েল বলেন, “অপমান সহ্য করতে না পেরে কিছু কিছু শিশু কান্নায় ভেঙে পড়ে।” কানেকটিকাট কলেজের মানব উন্নয়নসূচকের প্রফেসর সুনীল ভাটিয়া বলেন “গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য কোন মামুলি বৈষম্য নয়, এটা স্পষ্টত বিদ্বেষ। বর্ণবাদের কারণে গায়ের উজ্জ্বল রঙের বাণিজ্য ইউরোপ আমেরিকা থেকে অন্যান্য দেশের বিপনি বিতানগুলোতে ঢুকে পড়ছে বেপরোয়া গতিতে”।
সুনীল ভাটিয়া সম্প্রতি ইউএস নিউজ এবং ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে বলেন, বর্ণবিদ্বেষ সমাজের গভীরে শিকড় বিস্তার করেছে, গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছে সামাজিক স্তরবিন্যাস। সুস্থ ত্বক থেকে সুস্থ জীবন কিন্তু এই আপ্ত বাক্যটা শুধু তাদের জন্যই সঠিক যাদের ফর্সা ত্বক আছে এবং এই মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয়ের কাঠামো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। ফর্সা ত্বকের ধারণা রঙ ফর্সাকারী ক্রিম, প্রসাধনী বাজারে কোটি কোটি ডলারের বাজার সৃষ্টি করেছে, ফলে ত্বক ফর্সা করার জন্য বিভিন্ন পণ্য যেমন ব্লিচিং, ত্বকের উপর রাসায়নিক প্রলেপ, লেজার চিকিৎসা, স্টেরয়েড হরমোন, রঙ ফর্সাকারী ওষুধ এবং শিরায় প্রবেশ করার জন্য ইনজেকশন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিও মারাত্মক। সুতরাং গায়ের রঙ কোন ভাবেই বৈষম্য নয় বরং এটা আমাদের নিরুপায় সাংস্কৃতিক দৈন্যতা।
বহুজাতিক প্রসাধনী কোম্পানিগুলো পেয়ে গেছে রত্নভাণ্ডারের মত বিশাল লাভজনক বাজার। বাজার বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি এনালিস্ট ২০১৭ সালের জুনে এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাষ দেয় আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ত্বকের রঙ ফর্সাকারী প্রসাধনীর বাজার তিনগুণ বেড়ে ৩১.২ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদনে বলছে, গায়ের কালো ত্বক এখনো প্রবলভাবে নিগৃহীত এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি জোরালোভাবে উপস্থাপন করে ফর্সা ত্বক হলো সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিগত সাফল্যের প্রতীক।
ফর্সা ত্বকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব অনাদি কাল থেকে চলে আসছে এবং উপনিবেশের সময়ে সমাজের গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে। ফর্সা ত্বকের প্রতি মোহ শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তি যেসব দেশে শাসন করেছে সেসব দেশে মহামারীর মত আক্রান্ত হয়েছে। কবিতা ইমানুয়েল বলেন, “ফর্সা ত্বকের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এসেছে শাসক শ্রেনির ফর্সা ত্বকের কারণে। সারা পৃথিবীব্যাপী এটাই ধ্রুব সত্য যে ধনী প্রভু শ্রেণি আরামে বিলাসে সুন্দর প্রাসাদে বাস করে পক্ষান্তরে গরীব মানুষেরা সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফলে তাদের তাদের ত্বক হয়ে যায় কালো।
এখন বিশ্বায়ন গায়ের রঙের প্রতি পক্ষপাত প্রসারিত করছে। ফর্সা সুন্দরী মডেল ফর্সা ত্বকের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে আর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে উপনিবেশের স্থানীয় মানুষ গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্রিম কিনতে। সুনীল ভাটিয়া বলেন, “আপনি অতি সহজেই উপনিবেশবাদ, উপনিবেশবাদ পরবর্তী সময় এবং বিশ্বায়নের মধ্যে তুলনা রেখা আঁকতে পারবেন।”
পশ্চিমা সৌন্দর্যের ধারণা, ফর্সা ত্বক সারা পৃথিবী শাসন করছে। সৌন্দর্যের ধারণা দিয়েই ভোক্তাদের জন্য নিয়ে এসেছে রঙ ফর্সা করার বিভিন্ন পণ্য ও সেবা সামগ্রী। নাইজেরিয়ার ৭৭ শতাংশ নারীই রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের চলমান বিজ্ঞাপন আর টগোতে এই হার ৫৯ শতাংশ। কিন্তু রঙ ফর্সাকারী বিভিন্ন পণ্যের সবচেয়ে বড় এবং দ্রুত বর্ধণশীল বাজার হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো। যেমন ভারতে, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা যেকোন সুপার মার্কেটের দেয়ালে ত্বকের যত্ন নেয়ার যেসব বিখ্যাত ব্রান্ডের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখা যায় সেখানে লেখা থাকে ত্বকে আনে উজ্জ্বলতা, আর্দ্রতা ধরে রাখে।
বিকৃতি কোন পরিবর্তন নয়
মুম্বাইতে বেড়ে উঠা ২৭ বছরের পূজা কান্নান বছরের পর বছর রঙ ফর্সাকারী প্রসাধনী কিনতে ব্যয় করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, বিজ্ঞাপন প্রভাবিত মানুষ ভাবে, যদি তার ত্বকের উজ্জলতা বাড়ে। তিনি গায়ের রঙ ‘কালো ত্বক সমস্যা’ ফর্সা করতে ক্রিম, ফেসওয়াশ, সাবান ইত্যাদি কিনতে বাদ রাখেন নাই কিছু এবং এর পেছনে ব্যয় করছেন প্রতি মাসে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ রুপী যে পরিমাণ টাকা তার কলেজে যাতায়াতের এক সপ্তাহের খরচের সমান। চার বছর এক নাগাড়ে রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারের পরে তার ত্বক কিছুটা ফর্সা হয়েছে কিন্তু কিছুটা বিস্মিত হতে হয় যখন তাকে ক্রিম ব্যবহারের কারণেই হোক বা সুর্যের আলোর সংস্পর্শে তার ত্বকের সতর্ক যত্ন নেয়া জরুরী হয়ে পড়ে।
পূজা কান্নানের ত্বক প্রাকৃতিকভাবেই উজ্জ্বল বাদামী বর্ণের কিন্তু সে যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল তখন তার বাড়ির আত্মীয় স্বজন গায়ের রঙ কালো দেখে মাথা নাড়িয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। গায়ের রঙ কালো বলে তার আত্মীয় স্বজন বিদ্যালয়ের বন্ধু বান্ধব তাকে অপমান করে বলত, “পূজা তুমি কালো হয়ে গেছো” ভারতে ত্বকের রঙ অনেকক্ষেত্রেই সাফল্য, ভালো একটা চাকরি বা বিয়ের সময় প্রভাব বিস্তার করে। কান্নান বলেন, কেউ যখন তাকে বলত, তুমি তো কালো হয়ে গেছো তখন সে খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত। যখন আমি বাইরে যাওয়ার জন্য পোশাক পরতাম তখন আত্মীয়দের কথা মনে পড়তো এবং বেশি বেশি মেকাপ করতাম। কান্নান নিজে একজন নৃত্যশিল্পী কিন্তু তার কাছে মনে হতো গায়ের কালো ত্বকের জন্য সে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ফর্সা ত্বকের মেয়েরা নাচের মঞ্চের সামনের সারিতে স্থান পেতো। আমার জন্য বরাদ্দ পিছনের সারি।
Lancôme’s Blanc Expert line প্রজ্ঞাপন জারি করে বলে তাদের “evening” পণ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলে, আমাদের ত্বকের যত্নের পণ্যে শুধু রঙ ফর্সাকারী উপাদান আছে তা নয়, আমাদের পণ্য ত্বকের ভিতর থেকে বাড়িয়ে তোলে উজ্জলতা, ফলে আপনাকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ঝলমলে ত্বক। রঙ ফর্সাকারী প্রতিটি প্রসাধনী ব্র্যান্ডই একই ধরণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এসব পণ্য এশিয়া অঞ্চলের নারীদের নৈমিত্তিক সৌন্দর্য চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।এমা ত্রিনিদাদ নামের ফিলিপাইনের জনৈক নারী ভারতের বেঙ্গালুরুতে বিউটি সেলুন এবং স্পা পরিচালনা করেন। তিনিভারতে এসে গায়ের রঙের উপর নির্ভর করে বিয়ের সম্ভাবনা দেখে অবাক হয়ে যান।এমা ত্রিনিদাদ বলেন, “সম্ভাব্য পাত্রীরা ত্বকের রঙ ফর্সা করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন আর বিয়ের কয়েক মাস আগে হলে তো কথাই নাই, এই সময় তারা যত টাকা লাগুক ব্যাপার না আগে ত্বকের রঙ ফর্সা করবে। আমাদের ফিলিপাইনে এরকম কোন বালাই নাই।”
২০১৪ সালে ভারতের Advertising Standards Council একটা বিজ্ঞাপনে ত্বকের কালো রঙকে হীনভাবে উপস্থান করায় বিজ্ঞাপনটিকে বাতিল করে দেয়। বিজ্ঞাপন বাতিল হলেও বিজ্ঞাপনের পণ্যটি কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে ভারতে বাজারে দেদারছে চলছে। ত্বকের রঙ ফর্সাকারী বিজ্ঞাপন এখনো পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, বিল্বোর্ডের বড় বড় ক্যালিগ্রাফিতে শোভা পাচ্ছে। বলিউডের সুপারস্টার শাহরুখ খান, জন আব্রাহাম, দীপিকা পাদুকোন হাস্যজ্জ্বলভাবে ত্বকের রঙ ফর্সাকারী পণ্যের গুণগান গেয়ে যাচ্ছেন।
বলিউডের অভিনেতা অভয় দেওল একাধিক ফেসবুক পোস্টে তার সহকর্মীদের কাছে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের প্রচারণা চালান। তিনি হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় লেখেন, “রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, গায়ের ত্বক ফর্সা হলে ভালো চাকরি পাওয়া যায়, বিয়ে সুখের হয় এবং ফর্সা বাবা মায়ের সন্তান গৌরবর্ণ হয়। ফলে আমরা বিশ্বাস করতে থাকি যে, আমরা যদি ফর্সা হয়ে জন্ম নিতাম তাহলে আমাদের জীবন অনেক বেশি সহজ হয়ে যেত।”
গায়ের রঙ ফর্সা করার প্রবণতা শুধু আধুনিক প্রসাধনী শিল্পের একক কৃতিত্ব নয়। ভারতের ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদেরকে শেখায় গর্ভবতী নারী জাফরান মিশ্রিত দুধ, কমলা, মৌরী, নারকেলখণ্ড খেলে গর্ভের সন্তানের গায়ের রঙ ফর্সা হয়। ২০১৪ সালের প্রথমদিকে কলকাতার একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক সন্তান প্রত্যাশী যুগলদেরকে নিয়ে একটা পরামর্শসভার আয়োজন করেন যেখানে তিনি কালো বেটে যুগলদেরকেও ফর্সা এবং লম্বা সন্তানের স্বপ্ন দেখান।
২০১২ সালে ভারতের নারী স্বাস্থ্যের উপর পরিচালিত সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য। সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে, সন্তানহীন দম্পতিরা সারোগেট সন্তান পেতে সুন্দরী এবং ফর্সা ত্বকের অধিকারী নারীদের গর্ভ ভাড়া নিতে বেশি আগ্রহী এবং তার জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতেও প্রস্তুত যদিও সারোগেট সন্তানের জন্মদান প্রক্রিয়াতে গর্ভ ভাড়া নেয়া নারীর জীনগত কোন অবদান নাই।
সম্ভবত পত্রিকায় পাত্রী/পাত্র চাই শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ফর্সা ত্বকের অধিকারীকে বিয়ের জন্য চাওয়া হয়। পাত্র বা পাত্রীর গোত্র, ধর্ম, পেশা, শিক্ষা, শারীরিক বৈশিষ্ট্যর সাথে ফর্সা ত্বক অন্যতম যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।কেউ কেউ বলে কালো রঙের মেয়েকে পাশ কাটিয়ে ফর্সা মেয়েকেই সাধারণত পাত্রী হিসেবে পছন্দ করা হয়।
মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটাই এরকম খোলে নলচে বদলে গেছে যে খুব স্বাভাবিকভাবে বিয়ের আগে ত্বকের রঙ ফর্সা করাটা বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে গণ্য করা হয়। ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই এই প্রস্তুতি চলতে থাকে। ২০০১ সালে কার্তিক পাঞ্চাপাকেসান বিয়ে করেন তখন তিনি ‘বরের মেকাপ’ বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়ে নিজেই রঙ ফর্সাকারী সেবা গ্রহণ করে দেখেন। কমিউনিটি রেডিওতে কর্মরত গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ কার্তিক পাঞ্চাপাকেসান বলেন, “আমি আগে কখনো এরকম বিউটি সেলুনে যাইনি। কিন্তু যখন ত্বক ফর্সা করার কোন সেলুনের বিজ্ঞাপন শুনি তখন আমার কাছে বিষয়টাকে ইতিবাচক মনে হয় এবং তাদের কাছে যাই। বিউটি সেলুনের কর্মীরা আমার মুখে, কপালে, গালে, নাকে, ঘাড়ে সর্বত্র ফল আর ফুলের পেস্ট লাগিয়ে দেয় এবং আমাকে আশ্বস্ত করে যে এই পেস্ট ব্যবহারের ফলে আমার ত্বক ফর্সা হয়ে উঠবে।
কার্তিক পাঞ্চাপাকেসান বলেন, ফল আর ফুল মিশিয়ে বানানো সেই পেস্ট ব্যবহারের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার ত্বকে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায় এবং নাকের চারিদিকে জ্বলতে থাকে। মুহূর্তেই মিষ্টি সুবাস উৎকট ধোঁয়ার গন্ধে পরিণত হয়। তিনি অনুমান করেছিলেন, এই পেস্ট বানানো হয়েছে অ্যামোনিয়া দিয়ে। কর্তিক বলেন, “মনে হচ্ছিল এটাতে প্রাকৃতিক উপাদানের থেকে রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ বেশি।” যখন তার ত্বক পরিচর্যা শেষ হয়, তখন তার চেহারা দেখে মনে হয় ট্যালকম পাউডারের সাদা ধুলোয় ধূসরিত। কার্তিক বলেন, “এটা মোটেও কোন সৌন্দর্য বর্ধন নয়, বরং এটা হলো চেহারার বিকৃতি।”
প্রসাধনী ব্যবহারের বিপদ
বেশিরভাগ ত্বক ফর্সাকারী রূপচর্চার পণ্যগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ত্বকের পিগমেন্ট, মেলানিন যেগুলো মানুষের ত্বক, চুল চোখের রঙ নির্ধারণ করে। মেলানিন গঠনের জন্য প্রতিটি মানুষেরই সমপরিমাণ কোষ থাকে, কিন্তু কী পরিমাণ মেলানিন উৎপন্ন হবে সেটা নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের জীনের উপর। ত্বকে বেশি পরিমাণ মেলানিনের উপস্থিতি মানেই হলো সেই মানুষের ত্বক কালো হবে। কালো ত্বকের মানুষের শরীরে বয়সজনিত কুঁচকে যাওয়া এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কম হবে।
রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের প্রধান লক্ষ্যই থাকে মেলানিনের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করা অথবা মেলানিনবিহীন সাধারণ ত্বকের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ক্রিমের মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক সয়া, লিকারাস, আরবুটিন, চিকিৎসায় ব্যবহৃত উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার হাইড্রোকুইনান নামের একটি উপাদান। যদিও সব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের মধ্যে এই উপাদান থেকে না কিন্তু মনে রাখতে হবে হাইড্রোকুইনানের মধ্যে সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টি করার মত ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান। এই ধরনের উপাদানে প্রস্তুত প্রসাধনী পণ্য ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইভরি কোস্ট, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ অথবা ব্যবহার সীমাবদ্ধ। কিন্তু অভিযোগ আছে এইসব দেশে নিষিদ্ধ হাইড্রোকুইনানের যথেচ্ছ ব্যবহার বিদ্যমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কিছুদিন আগেও ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম এবং সাবানের মধ্যে পারদের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। পারদ মেলালিন উৎপাদন বাধাগ্রস্থ করলেও ত্বকে বা শরীরের কোন অঙ্গে ব্যবহার করলে কিডনি এবং মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
লেজার ট্রিটমেন্ট আরও ভয়ানক। লেজার ট্রিটমেন্টের কারণে ত্বকের পিগমেন্টে ভেঙে যায় ফলে অনেক সময় ত্বক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভারতের বেঙ্গালুরুর একজন ত্বকের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুজাতা চন্দ্রাপ্পা বলেন, “ভারতের নারী পুরুষের মাথায় সব সময় ফর্সা হওয়ার মানসিক চাপ থাকে। তাদের সামনে বিজ্ঞাপন, সিনেমা, সিরিয়ালের কিছু রোল মডেল আছে এবং তারা যেকোন মূল্যে তাদের মতো হতে চায় এবং পুরো বিষয়টা খুবই ভ্রান্তিতে পর্যবসিত।”
ডাক্তার সুজাতা চন্দ্রাপ্পা বলেন, “আমার কাছে অনেক সময় কিছু সেবাগ্রাহক আসে, যাদের চাহিদা থাকে বলিউডের অমুক তারকার মতো তার গায়ের রঙে জেল্লা এনে দিতে হবে। গায়ের ফর্সা ত্বকই যদি তাদের একমাত্র চাওয়া এবং দুর্বলতা হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলবো এবং আমি শংকিত যে তারা এমনকিছুর তালাশ করছে যা তাদের মোটেও দরকার নেই। যদি আমি তাদেরকে ফর্সা ত্বকের জন্য উৎসাহিত করি, তবে আমার মনে হয় যেন আমিও বর্ণ বিদ্বেষ উস্কে দিচ্ছি।”
শানা মেন্ডোইলা প্রতি মাসে ৩২০০ রুপি শুধু ত্বক ফর্সা করার জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধ কেনার পিছনে ব্যয় করেন, যে পরিমাণ অর্থ স্থানীয় মানদণ্ডে অনেক। যদিও মেন্ডোইলা একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করেন। শানা মেন্ডোইলা ফিলিপাইন বংশোদ্ভূত হলেও এখন বেঙ্গালুরুতে কর্মসূত্রে বসবাস করছেন। মেন্ডোইলা বলেন, শুধু ত্বক ফর্সা করার জন্যই গত পাঁচ বছর ধরে তিনি এই ওষুধ গ্রহণ করছেন তা নয়, বরং এই ওষুধের এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদানের কারণেই এই ওষুধ গ্রহণ করছেন।
ইমেইলে তিনি আমাকে বলেন, “সমুদ্র সৈকতে যেতে আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলে মনে হয় আমি আসলেই কালো হয়ে গেছি। আমি সব সময় ত্বকের রঙ ফর্সাকারী উপাদানের প্রসাধনী যেমন বডি লোশন, ফেসওয়াশ, ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষাকারী ক্রিম কিনতে পছন্দ করি”।
ফিলিপাইনে ফর্সাদের সর্বত্রই সামাজিক সুবিধা বেশি। শানা মেন্ডোইলা নিজেকে বাদামী বর্ণের ত্বকের অধিকারিণী মনে করেন, তার ত্বক খুব ফর্সাও নয় আবার কালোও নয় এবং তিনি বলেন, এই ওষুধ গ্রহণের পর তার ত্বক দ্রুত স্বরূপে ফিরে আসে। সমুদ্র সৈকতের পোড়া ত্বক যখন স্বাভাবিক হয়ে যায়, ফিরে আসে স্বাস্থ্যকর উজ্জ্বলতা তখন কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের সাথে মেশার সময় আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কেনই বা হবে না? আমাদের মধ্যে কে না চায় তাকে দেখতে সুন্দর লাগুক। শানা মেন্ডোইলা যে ওষুধ গ্রহণ করছেন সেটা হলো গ্লুটাথিওন। আমাদের লিভার প্রাকৃতিকভাবেই এন্টি অক্সিডেন্ট তৈরি করে যা ত্বককে ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি, তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু গ্লুটাথিওন ত্বকে জেল্লা নিয়ে এলেও ত্বক এবং মেলানিনের ক্ষতি করে।
ডাক্তার শ্যামন্তা বড়ুয়া বলেন, “কেউ যদি এই ওষুধ গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়, তখন তাদের ত্বকে জ্বালাপোড়া শুরু হয় এবং ফুসকুড়ি দেখা দেয়। সুতরাং তারা আবার এই ওষুধ ব্যবহার করতে বাধ্য হয় এবং ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরোতে পারে না, এটা একটা ক্ষতিকর বৃত্তের চিরন্তন আবর্তন।
গ্লুটাথিওনের সরাসরি ব্যবহার হয় শিরায় ইনজেকশন প্রবেশের মাধ্যমে। সাধারণত কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন বমি বমি ভাব, চুলে পড়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি প্রতিরোধে এই ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ত্বকের রঙ ফর্সা করার উপাদান হিসেবে এই ওষুধের ক্রমাগত ব্যবহার ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানকে ভাবিয়ে তুলেছে। ২০১১ সালে ফিলিপাইনের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগ জনসাধারণকে সতর্ক করে প্রজ্ঞাপন জারি করে “সাম্প্রতিক সময়ে শিরায় প্রবেশের মাধ্যমে অনুমোদনবিহীন গ্লুটাথিওনের ব্যবহার উদ্বেগজনহারে বেড়ে গেছে।”
সেখানে গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, গ্লুটাথিওনের ব্যবহারের ফলে ত্বকে জ্বালাপাড়া, ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে, থায়রয়েড এবং কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে, এমনকি পোড়া ত্বকের মতো এক স্তর উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসম্পর্কে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন ভোক্তাদেরকে সম্ভাব্য ঝুঁকির জন্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, “আপনি হয়তো আপনার শরীরে প্রবেশ করাচ্ছেন অপরিচিত কোন রাসায়নিক দ্রব্য, আপনি জানেন না এই রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে কী উপাদান বিদ্যমান অথবা কীভাবে সৃজন।”
এতো স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সতর্ক করে দেয়ার পরেও এসব পণ্যের ব্যবহার এবং চাহিদা লাগামহীন বেড়েই চলেছে। শানা মেন্ডোইলা শিরায় প্রবেশ করানো গ্লুটাথিওনের ইনজেকশন এবং গিলে খাওয়ার বড়ি দুইটা পদ্ধতিতেই অভ্যস্ত, কিন্তু বিশেষ করে গিলে খাওয়ার উপরেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বেঙ্গালুরুর ত্বকের চিকিৎসক এবং সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মুক্তা সাচদেব ক্লায়েন্টদের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের শিয়ার অনুমোদনহীন গ্লুটাথিওন ইনজেকশন প্রবেশ করাতে অস্বীকৃতি জানায়।
তিনি জানান, “আমি ত্বকের রোগের পূর্বাপর ইতিহাস এবং তথ্য প্রমাণ ছাড়া চিকিৎসার ওষুধ দিই না এবং গ্লুটাথিওনের স্বপক্ষে যথেষ্ট রিভিউ লিটারেচার না থাকায় আমি এটা ব্যবহার করি না। তিনি আরও বলেন, ইউটিউব ভিডিওতে কীভাবে গ্লুটাথিওন ইনজেকশন করবেন তার উপায় বাতলে দেন।” চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে মানুষের ত্বককে স্থায়ীভাবে উজ্জ্বল করা সম্ভব নয়। ডাক্তার সাচদেব, “তবু মানুষের চেষ্টার অন্ত নাই।” প্রকৃতপক্ষে তার বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট ত্বক ফর্সা করার চিকিৎসার জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। প্রথমত তারা স্টেরয়েড ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে আগ্রহী থাকেন।
ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের দেশে রঙ ফর্সা করতে প্রত্যাশীদেরকে ত্বকের উপরিভাগে ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ১৮ পদের কর্টিকস্টেরয়েড হরমোনাল ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সহনীয় মাত্রায় বাকিগুলো মাত্রাতিরিক্ত। এসব ওষুধের একটা টিউবের দাম ১.৫০ পাউন্ডের থেকেও কম এবং দেশব্যাপী সব ওষুধের দোকানগুলো ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে এমনকি ডাক্তারের কোন ব্যবস্থাপত্রেরও দরকার পড়ে না।
মানুষ নির্বিচারে এইসব ওষুধ মুখের ব্রণ চিকিৎসায় বা ত্বক ফর্সা করতে দেদারসে ব্যবহার করছে। কিন্তু এইসব স্টেরয়েড ক্রিম ত্বকের সুরক্ষাদানকারী উপরের অংশ তুলে ফেলছে। ফলে অতি সহজেই ত্বক সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে, অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে চলে আসছে, পরিবেশ দূষণের প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে, চারিদিকে ভাসমান ধুলোবালি, সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।
ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শ্যামন্ত বড়ুয়া বলেন,“তার থেকেও ভয়ানক ব্যাপার হলো স্টেরয়েড ব্যবহারকারীরা এই ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে”। ত্বকের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের উপর মানসিকভাবে আসক্ত হয়ে যায়।
তিনি মনে করেন এসব ওষুধ ব্যবহারকারীদেরকে মস্তিষ্কে বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদক বা মদে আসক্তদের মত নিবিড় পরিচর্যা করা দরকার। কিছু কিছু সময় দেখা যায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে অযথা স্টেরয়েডের অনুমোদন। কখনো স্টেরয়েড, এন্টিবায়োটিক এবং এন্টিফাঙ্গালওষুধের যৌথ প্রয়োগ ফলে রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যহত হয়। হায়দারাবাদের ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রজত দামিশেঠি বলেন, ক্লোবেটাসল মিশ্রণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত স্টেরয়েড যা সাধারণত একজিমা আক্রান্ত জ্বালাপোড়া ত্বকে ব্যবহৃত হয়। শুধু এশিয়া অঞ্চলেই মানুষ এন্টিবায়োটিক আর এন্টিফাঙ্গাল ওষুধের এমন অদ্ভুত পাগলা মিশ্রণ ব্যবহার করে এবং ফলাফলটাও দুঃস্বপ্নের মত।
সাধারণত ফাঙ্গাস সংক্রমণের কারণে ডাক্তার ৭০ থেকে ৯০ ভাগ রোগীদেরকে ত্বকের উপরের অংশে স্টেরয়েড ব্যবহার করার অনুমতি দেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে উপশম পেয়ে যান। কিন্তু এখন আমাদেরকে রোগীর চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করে আট থেকে বারো সপ্তাহের হিসেবে চারগুন বেশি ডোজ দিতে হচ্ছে এবং এই দৃশ্য সারাদেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
দৃষ্টিভঙ্গির কি পরিবর্তন আসবে?
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে ত্বকের রঙের উপর নির্ভর করে বৈষম্য দূরীকরণের প্রচারকবৈষম্য দূর করার থেকেও এখন অসৎ চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং উগ্র ভোগবাদী চর্চার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বছরের পর বছর তারা ফর্সা ত্বকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দূরীকরণে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। যাই হোক না কেন, Women of Worth এর প্রতিষ্ঠাতা ইমানুয়েল কবিতা খুব আশাবাদী। তিনি মনে করেন, ত্বকের রঙের কারণে বৈষম্য নিয়ে মানুষ পূর্বের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে হয়তো বিষয়টাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবে, সারা পৃথিবী থেকে বৈষম্য চিরতরে দূর হয়ে যাবে।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী ইনস্টাগ্রামে “আনফেয়ার এবং লাভলী” প্রচারণা শুরু করে। উল্লেখ্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী এশিয়া অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় রঙ ফর্সাকারী ক্রিম। আনফেয়ার এবং লাভলী আন্দোলনে টেক্সাস এবং অস্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তিন ছাত্রী হ্যাশ ট্যাগের মাধ্যমে কালো ত্বকের মেয়েদেরকে ইনস্টাগ্রামে তাদের ছবি পোস্ট আহ্বান করেন।
২০১৩ সালে পাকিস্তানের কিশোরী ফাতিমা লোদি সেদেশে প্রথমবারের মত প্রথম বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কালোকে স্বর্গীয় বলে প্রচার করেন। কালো শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে তাকে কী কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে লিখেছেন এভাবে, “স্কুলের নাটকে আমি কখনো পরী সাজার সুযোগ পাইনি, কারণ পরীদের ত্বক হতে হবে ফর্সা! ফাতিমা লোদি এখন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ত্বকের রঙের কারণে বিদ্যমান বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছেন।”
ঘরের বাইরে বের হয়ে নারীগণ শিক্ষায়, পেশাগতজীবনে, আর্থিকক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুবাদে তাদের মাঝে ব্যাপক মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে বৈষম্যের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই শহরের সব মাধ্যমিক স্কুলে বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণের প্রচারণার সময় ‘কালো জগতের আলো’ হিসেবে উপস্থাপন করেন ইমানুয়েল। কালো রঙের অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রীর একটা কিশোরী গভীর মনোবেদনায় আচ্ছন্ন। স্কুলে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ প্রচারণা চলার সময়েই সে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, কারণ ঠিক সেদিন সকালেই তার ভাই গায়ের রঙ কালো বলে তাকে অপমান করেছে।
ইমানুয়েল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন যখন দেখলেন একটা ফর্সা ত্বকের মেয়ে ক্লাসে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এই বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ প্রচারণার আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম কালো মেয়েরা বুঝি কুৎসিত হয়, কিন্তু আমি কালো মেয়েটার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থী এবং প্রতিজ্ঞা করছি, কোনদিন কাউকে গায়ের রঙের কারণে খারাপ ব্যবহার করবো না।” তার কথা শেষ হতেই সবাই তুমুল করতালিতে তাকে অভিবাদন জানায়।
ইমানুয়েল বলেন, “কিশোর বয়সীদের মাঝে দারুণ পরিবর্তন আসছে এবং গায়ের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য করবে না বলার মতো মহত্ত্বের আর চৈতন্যের আলোকযাত্রা শুরু হয়েছে”।
লেখক: কবি,অনুবাদক, ব্লগার