আনন্দময়ী মজুমদার:
১) গ্যাস-লাইটিং নিয়ে আমরা বেশির ভাগ কিছু জানি না। একটু পড়লেই অবশ্য জানা যায় যে গ্যাস লাইটিং হলো এমন কিছু করা যা কিনা অন্য কারো অন্তরের ভাষা, কণ্ঠস্বর, অনুভূতি, বোধ, চাওয়া, প্রয়োজন বা সত্যকে খারিজ করে দেয়, সেটা ‘ভুল’ বলে দাবী ক’রে।
যেমন আমরা বাতিল শিশি-বোতল, অচল টাকা, খারিজ করে দিই, তেমনি যখন কারো মতামত, অনুভূতি, বোধ, ইচ্ছে, চাহিদা, চিন্তাকে রাতারাতি খারিজ করা হয় ও সম্পূর্ণ অন্য গল্প চালু করা হয়, তাকেই বলে গ্যাস লাইটিং।
২) একজন শিশু যদি রোজ শোনে তার ব্যথা আসলে ব্যথা না, তার প্রয়োজন আসলে প্রয়োজন না, তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো দাম নেই, সে যা বুঝছে আসলে ভুল বুঝছে, তাহলে সে তার নিজের স্বাধীন অনুভূতি, চেতনা, ইচ্ছে, চিন্তাশক্তি আর বিবেচনাবোধের ওপর এমনভাবে সন্দেহাতুর হয়ে পড়বে যা আর কোনোদিন মজবুত মেরুদণ্ডে দাঁড়াতে পারবে না।
৩) দীর্ঘদিনের গ্যাস-লাইটিং একজন মানুষের আত্ম-শক্তিকে খর্ব করে দেয়। তাঁর নিজের আত্ম-সম্মান ও আত্ম-মূল্যকে ধুলিস্মাৎ করে।
আত্ম-মূল্য ছাড়া মানুষের বাঁচার আর কোনো অবলম্বন নেই।
অনেক সময় যে গ্যাস-লাইটিং করছেন তিনি জানেন না বিষয়টা কেমনতর ক্ষতিকর। অনেক সময় গ্যাস-লাইটিংকে আপাত নিরীহ বলেই মনে হয়।
৪) গ্যাস-লাইটিং এর আওতায় আমরা প্রায় সকলেই পড়ি। কখনো হয়তো আমরাই তা করি, কখনো আমাদের তা করা হয়।
৫) বেশির ভাগ নারী খানিকটা সংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপ নিয়েই বলতে পারি এই গ্যাস লাইটিঙের আওতায় পড়েন। তাদের মতামত, কণ্ঠ, তাদের গল্প, তাদের অনুভূতি, চিন্তা, সিদ্ধান্ত ভুল বলে খারিজ হয়। তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অমার্জনীয় ভুলের মোটা অঙ্কের খাতার মতো লাল দাগে ভরা।
৬) মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় displacement বলে একটা কথা আছে। সহজ ভাষায় displacement হলো সেই নেতিবাচক আচরণ যা ‘ক’ ‘খ’ এর কাছ থেকে পায়, যা সে অকারণে ‘গ’ এর ওপর চালনা করে। যেমন বস কড়া কথা বলেন তাঁর অধস্তনকে, অধস্তন বসকে কিছু না বলে বাড়ি এসে ঝাড়ি দেন তাঁর স্ত্রীকে। স্ত্রী কিছু বলতে না পেরে মার দেন বাচ্চাকে, ইত্যাদি।
যারা গ্যাস-লাইটিঙের আশৈশব শিকার, তারা অধস্তন কাউকে গ্যাস-লাইটিং করে থাকেন। সেইজন্য গ্যাস লাইটিং সমাজের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে সহজে চালিত হতে থাকে। এর শেষ নেই, যদি না সচেতন হওয়া যায়।
৭) এটা অতি-কথন নয়। এর বাইরে পড়েন তারা হয়ত ব্যতিক্রম। ভাগ্যবানও বটে।
৮) পরশুরাম ওরফে রাজশেখর বসুর বিখ্যাত হাসির গল্প চিকিৎসা -সংকট থেকে একটুখানি নিচে উদ্ধৃত করা হল, গ্যাস-লাইটিং নিয়ে আমরা যে অভিহিত, এবং চিনতে পারলে যে এভাবেই হাসির খোরাকে পরিণত করাই উত্তম, সে কথা ভাবতে গিয়ে!
“সব অসুখের কথা কি মানুষ জানতে পারে? পারে না… জানে শুধু তারিণী কোবরেজ মশাই।
বমি হয়?
আজ্ঞে না।
হয় হয় হয়, জানতি পারো না।
দাঁত কন কন করে?
আজ্ঞে না।
করে করে করে, জানতি পারো না।
আমার ব্যারামটা কী?
এরে বলে উদুরি। তোমার যা হাল দেখসি তোমার তো মাঝে মাঝেই প্রাণ সংশয় হয়।
সে কি? কই সে রকম কিছু —
হয় হয় হয় জানতি পারো না।”
(পরশুরাম, চিকিৎসা সংকট)
[কৈফিয়তঃ
৪) শৈশবকে আমি আমল দিই। ভূমির মতো শৈশব আমাদের ধারণ করে রাখে। তাই কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলি, শৈশবকে আমল দিই, এটাই কৈফিয়ত এই লেখার জন্য।
৩) আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আমরণ একটা শিশু আছে ও থাকবে। শিশুদের ইস্কুলের পিঠের ব্যাগ ভারী হলে সেটা দুঃখের, সন্দেহ নেই, কিন্তু শিশুদের আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়ানো নানা ভুলের বোঝাও ভারী হতে পারে যদি না তারা তা সময় বুঝে ঝেড়ে ফেলে দেয়।
২) বিজ্ঞান, আর্ট, সংস্কৃতি, বাড়ির মডেল, গয়না শাড়ী ও ফ্যাশন পাল্টাচ্ছে। তাই রীতি মেনে শিক্ষার রীতিনীতি পাল্টাবে এটাই স্বাভাবিক হয়ত। হালের শিক্ষা বলতে আমাদের কাছে নিজের মত পড়াশুনো করা বোঝায়; ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন শিক্ষা আহরণ করার দিগন্ত আমাদের নানাভাবে প্রসারিত হয়ে গেছে। শিক্ষাদীক্ষা কিছু কিছু তো যুগের নিয়মে পাল্টে যাবে ঠিক যেমন পাল্টায় ফ্যাশন এবং টাকার দাম, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
১) আজকাল ডিগ্রীর বাইরে পড়াশুনো করার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়। এবং তারপরও আড়ালে সকলে বলে ঐ যে দেখো আঁতেল, ওই দেখো বোদ্ধা (আমেরিকানরা বলে গীক)!
এতো কৈফিয়ৎ হয়তো সেই সব কারণেই!
নিজের মত পড়াশুনো যে অন্যায়, দোষের যোগ্য, স্বকীয় চিন্তা আর মুক্ত চেতনা যে থাকতে নেই, এই গ্যাস-লাইটিং থেকে কি আমরা স্বাধীন হতে পারবো?