ঈহিতা জলিল:
রীতা রাজধানীর একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মাও সমাজে শিক্ষিত ও সচেতন হিসাবে পরিচিত। মেয়েটি একি সঙ্গে উচ্ছ্বল আবার কেমন যেনো উদাসীন। অবশ্য ওর বয়সটাই অমন। কিন্তু শুধুই কি বয়স নাকি ওর হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ এর পিছনে অন্য কোন কারণ আছে?
খোঁজ করে জানা গেলো রিতার মা-বাবার সাথে প্রয়োজনের বাইরে ওর কোন কথা হয় না। বাবার সাথে ফ্রি হলেও অতোটা ফ্রি না যে ওই সব বিষয়ে কথা বলতে পারবে। এই “ওইসব বিষয়টা কোন সব বিষয়”!!?? জানা গেলো রীতার গৃহ শিক্ষক পড়াতে গেলে নানাভাবে ওর হাত ধরতে চায়, পা দিয়ে পায়ে ঘষা দেয়। ও স্কুলে ওর খুব কাছের দুইজন বন্ধুদের কাছে বলে ওর খারাপ লাগা, ভয় আর শঙ্কার কথা। উল্লেখ্য, নবম শ্রেণিতে পরলেও যৌন জীবন সম্পর্কে ওদের কোন ধারণা নেই। ওরা বোঝে বন্ধ দরজার ভিতর স্বামী-স্ত্রীর আলাদা একটি জীবন আছে। কিন্তু সেটি কি তা তাঁদের জানা নেই।

রীতা বোঝে ওর গৃহশিক্ষকের স্পর্শটি কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু বোঝাতে পারে না। যেদিন শিক্ষকটি ওকে জোর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে চাইলো, ও ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো। পরদিন স্কুলে ওর বন্ধু রিনি বলেছিলো, “তুই যদি আজকে আন্টিকে না বলিস, তাহলে আমি বলে দিবো”। রীতার মা প্রায় সময়ই রিতাকে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে চলে যেতেন! আর শিক্ষক মহাশয় এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেন। রিনির বাবা-মা কিন্তু রীতার বাবা-মায়ের মতো অতোটা শিক্ষিত আর সচেতন ছিলো না, কিন্তু মেয়ের সাথে তাঁদের সহজ একটি সম্পর্ক ছিলো, যেখানে সন্তান মন খুলে সব বলতে পারতো। রিনির আত্মবিশ্বাস এর মূল উৎস ছিলো সেটি-ই।
মনন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে। নতুন প্রেম হয়েছে মমর সাথে। মম খেয়াল করেছে মননের তেমন কোন বন্ধু নেই। আর প্রায়দিনই মননের চোখ খুব লাল আর ক্লান্ত থাকে। একদিন মম জিজ্ঞেস করেই ফেলে, “তোমার চোখ এতো লাল কেনো, আর এতো ক্লান্ত কেনো লাগছে? রাতে ঘুমাওনি”? কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো, “রাতে মসজিদে শুয়েছিলাম। অনেক মশা ছিলো ঘুমাতে পারিনি”। অবাক হয়ে মম জানতে চাইলো, “রুম ছেড়ে মসজিদে কেনো”? অসহায় মুখ করে মনন বললো, “জানলে তুমি আমাকে খারাপ ভাববে”। ততক্ষণে মমর কৌতুহল বাঁধ ভেঙেছে। “তবু শুনবো”।
ঘটনা জানা গেলো, মননের সিনিয়র রুমমেট সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট। খুবই গুণ্ডা প্রকৃতির লোক। নানানভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে মননের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তাই সে রুমে ফেরার আগেই মনন মসজিদে ঘুমানোর জন্য চলে যায়। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারানো মনন মা আর বোন ছাড়া আর কারো সাথেই তেমন মেশেনি। আর পুরুষ আত্মীয়ও কাছের কেউ তার জীবনে নেই। ঘটনা সে নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি অন্যকে কী বোঝাবে!
উপরের দুটি ঘটনায় আমরা দেখলাম মেয়ে এবং ছেলে দুজনেই আক্রান্ত এবং তাঁরা কেউই পরিবারের মানুষের সাথে ফ্রি না। তাহলে আমাদের করণীয় কী?
# শিশুর বয়স তিন হলেই ডেঞ্জার পয়েন্ট শেখান।
# কেউ যদি ডেঞ্জার পয়েন্টে জোর করে স্পর্শ করে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করা শেখান।
# ছেলেমেয়ের সাথে সহজ সম্পর্ক রাখুন যেনো যে কোন বিষয়ে তাঁরা আপনাকে প্রশ্ন করতে পারে।
# বয়স অনুযায়ী যৌনশিক্ষা দিন। বাইরে থেকে ভুল শিক্ষা পাওয়ার চেয়ে আপনার কাছ থেকে সঠিক শিক্ষা পাওয়া জরুরি।
# প্রশংসা ও সমালোচনার সঠিক ভারসাম্য করুন। কোনটাই অতিরিক্ত করবেন না।
# বয়োঃপ্রাপ্তির বয়সে ওরা এমন অনেক আচরণ করবে যা আপনার রাগের কারণ হবে, কিন্তু রাগ না হয়ে ধৈর্য্য ধরুন। আপনার সেই বয়সের কথা ভাবুন।
# সন্তানের আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন। সে কী করে, কোথায় যায়, কার সাথে মিশে এসব।
# খেয়াল রাখুন। গোয়েন্দাগিরি না। মনে রাখবেন শিশু বলে তাঁর ব্যক্তি জীবন থাকবে না। তা না!!
# বয়স্ক পুরুষ দ্বারা যেমন কন্যাশিশু নির্যাতিত হতে পারে, তেমনি বয়স্ক নারী ও পুরুষ উভয়ের দ্বারাই পুত্র শিশুও নির্যাতিত হতে পারে। “আমার তো ছেলে বাচ্চা আমার অতো খেয়াল না রাখলেও চলবে”- এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন।
# অতি সতর্ক হতে যেয়ে স্বাভাবিক মেলামেশায় অহেতুক সন্দেহ করবেন না। এতে পরিবারের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখুন।
# সন্তানের বন্ধু হোন, কিন্তু আপনারা যে মা-বাবা এটি যেনো তারা ভুলে না যায়। নিজেদের সম্মান করুন, তাহলে সন্তান নিজ ও অন্যকে সম্মান করতে শিখবে।
# ধাক্কা দেয়া আর লেগে যাওয়া। একটি ইচ্ছাকৃত, অপরটি অনিচ্ছাকৃত। এই দুইয়ের পার্থক্য নিজে শিখুন এবং সন্তানকেও শেখান।
# বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো শেখান।
# বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে শিশুকে সম্পৃক্ত করুন। মনে রাখবেন পরীক্ষার রেজাল্ট শিটে এ+ পাওয়ার চেয়ে জীবনের রেজাল্ট শিটে এ+ পাওয়া বেশি জরুরি।
সব পিতা-মাতাই সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সেই আশ্রয়ের অনুভব করানো ভীষণ জরুরি। সন্তানকে বোঝান পরিবারের মধ্যে ঝগড়া হবে, মতবিরোধ হবে, কিন্তু দিনশেষে তাঁর পরিবার একটা টিম। আর এই টিম তাঁর সকল ভালো-মন্দের অংশীদার।
রবিবার
২০.০১.১৯
সন্ধ্যা – ০৭.১৩ মিনিট