উম্মে হাবিবা সুমী:
১/
‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ’, – কিশোর বয়সে যখন অনেক পথ হেঁটে হেঁটে পড়তে কিংবা স্কুলে যেতাম মনের অজান্তে গুণগুণ করে বলতাম একথা, কখনও কখনও ইচ্ছে করে পথ হারাতামও, ফিরতামও আবার ঠিক ঠিক ঘরে।
ফিরতে ফিরতে ভাবতাম, কোনটা আমার ঘর? মায়ের মায়ের বাড়ি, বাবা’র অকালে পরপারে চলে যাবার কারণে যেখানে থাকি, সেটা? নানী এবং আমার মা – দু’জনেই তাদের বোধ আর বিশ্বাস থেকে মনে করিয়ে দেন, যদিও থাকি ওটা তবু আমার বাড়ি নয়, আমার বাড়ি নাকি আমার বাবার বাবার বাড়ি! হুম, আমি জানি সেটাও আমার বাড়ি নয়, কেননা ওখানে দহলিজের সিন্দুকে সংরক্ষিত বংশতালিকায় কোনদিন আমার নাম থাকবে না, মেয়ে বলে যেমন থাকেনি আমার ফুপুদের নাম।
সবকিছু ছাড়িয়ে তবু একটা দেশ ছিল, থাকবার, ভাবাবার। দেশ ছিল কল্পভূমি’র মতো, আদর্শিক ঠিকানা’র মতো, মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা’র মতো।
২/
কৈশোর ছাড়িয়ে তারুণ্য কড়া নাড়ছে দরজায়। বোর্ডে কীভাবে যেন প্রথম হবার মতো দারুণ একটা ঘটনা হয়েছে। একজন চাচা, দূরদর্শী জ্ঞানী মানুষ তিনি, বললেন, – ‘ভালো রেজাল্ট করেছিস, টোফেল দে স্কলারশিপ এর খোঁজখবর কর, বিদেশে চলে যা, পারলে অ্যামেরিকায়, গিয়ে থেকে যাবি, ফিরবি না… এ দেশে কিচ্ছু হবে না’।
‘এ দেশের কিচ্ছু হবে না’ – টাইপের কথা শুনলে আমার কোথায় যেন গিয়ে লাগে, সইতে পারি না। সুতরাং ততোধিক বিজ্ঞের মতো বলি – ‘আমি কি অ্যামেরিকায় প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করতে পারবো?’, ‘পারবো না, সুতরাং গরীব দেশ এর রাজা হবার অধিকার ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না’।
৩/
ইউনিভার্সিটিতে আমি তখন, তুমুল তরুণ জীবন। স্বপ্ন দেখার নেশা আমার ছাড়েনি কখনো। বদলে দেবার স্বপ্ন নেশায় কখন যেন আরও কয়েকজন বন্ধু সমেত ঢাকা ইউনিভার্সিটি’র মেয়েদের সন্ধ্যার আগে আগে হলে ফেরার নানান নিয়মকানুন বদলাবার আন্দোলন করে ফেললাম; বরাবর লাজুক –চুপচাপ আমি কেমন করে সেই ‘সূর্যাস্ত আইন বিলোপ’ আন্দোলন এর সংগঠক হয়ে উঠলাম, সেটা আরেকটা গল্প, আরেকদিনের জন্য। তখন একদিন, – ফুলমামা চলে গেলেন, প্রবাসী হয়ে।
ফুলমামা আমার খুব প্রিয় মানুষ, তার হাত ধরে পোস্টার লেখা শিখেছি, ঘোর কূপমণ্ডূক রাজাকার-প্রধান আমার এলাকায় কলেজে রাজাকারদের বিরুদ্ধে দেয়ালিকা বানিয়ে একা একা টাঙ্গিয়ে দিতে আর তারপর তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষকদের সাথে যুঝতে শিখেছি। ফুল মামা- মেধাবী একজন নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তার, বেহিসেবে সেবা দিতে রাতদিন জেগে থাকেন, – সেই তিনি চলে যাবেন, মানতে পারলাম না, রেগে গিয়ে বলি, -‘মামা, এটা ব্রেন ড্রেন, আর যেই যাক,- আপনি কেন যাবেন?’ ভিশনারী মামা আমার হাসলেন, বললেন নানা কথা আর যুক্তিও, তবু কানে ঢুকেনি কিছুই, চোখটা ঝাপসা হওয়া ছাড়া।
৪/
তারপর একদিন আমার আর আমার পরিবারের অনেকের আজীবনের মেনটর মেঝো মামাও সপরিবারে দেশান্তরি হলেন, কারণগুলো ততদিনে আমার কাছে খানিকটা যুক্তিগ্রাহ্য হতে শুরু করেছে, যদিও আমি জানি, – আমি যাচ্ছি না, অসমাপ্ত পড়াটা শেষ করতে যাবার ইচ্ছেটুকু ছাড়া। লন্ডনের পড়া অসমাপ্ত রইলো, দেশে ফিরে নতুন জীবন, আর জজিয়তি’র নতুন চাকরি, – আমার ভাবার খুব সময় ছিল না।
৫/
একটা একটা করে দিন যায়, বদলায়, তারপর একদিন আসে আমার দিন।
আমার আর লন্ডনে অসমাপ্ত পড়া শেষ করতে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। মৌলভীবাজারে নিঃসঙ্গ প্রায় এক জীবন কাটিয়ে ঢাকায় এসেছি বদলী হয়ে। আমার স্কলারশিপের, শিক্ষাছুটির অনুমতির আবেদন নিবেদন ক্রমাগত ব্যর্থ হয় আমলাতন্ত্রের দরজায়। ঢাকা কোর্ট এর টিনশেড এ পারিবারিক আদালত এর বিচারক তখন, বিদ্যুৎ থাকে না প্রায়শই, হুটহাট খাস কামরার দরজায় হানা দেয় হকারেরা, তার মধ্যে দিনরাত কাজ আর কাজ, নাভিশ্বাস; মাঝে মাঝে বন্ধু পাপিয়া আসে, অপরাহ্ণের দিকে, ছোট ছোট গরম শিঙ্গাড়া খাই দুজনে। সেই একদিন বলে, ‘তুমি কানাডায় যাও না কেন, ইমিগ্রশন থাকলে কম খরচে পড়ে আবার ফিরে আসো…’।
পাপিয়াই খুঁজে খুঁজে অন্য বন্ধু’র নাম্বার যোগাড় করে দেয় যে আমাকে এ ব্যাপারে আরও উৎসাহ দিতে আর সাহায্য করতে পারে। ইতিমধ্যে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়েও ছুটি মিললো না, বরং বদলি হলাম যখন অন্য অনেককে স্কলাররশিপ, ছুটি সবই দেয়া হলো। মন খারাপ করে পথে নামি নতুন কোন স্বপ্নের খোঁজে, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা কঠিন তাই।
এর মধ্যে আমাকে পথে নামিয়ে দিয়ে বন্ধু পাপিয়া হুট করে চলে গেল। হু হু করা এক শীতের বাতাসের শীষের শব্দে মিশে খুন কিংবা হত হলো মেয়েটা, অন্য মেয়েদের বিচার চাইবার কাজ করে করে ভুলে গেল নিজের প্রতি সুবিচার এর কথা, মেয়েকে একলা রেখে চলে গেল না ফেরার দেশে।
৬/
পৃথিবীটা খুব ফেয়ার মানে ন্যায়পর ছিল কি কখনো? যে অন্যের সুবিচার নিশ্চিত করতে প্রাণান্ত হয়, অবিচার কি তার বড় বেশি প্রাপ্য হয়ে ওঠে?
বারবার বদলী শেষে সিলেট যাত্রা, ভাবি একটু শান্তি মেলে যদি।
শান্তি বহুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ রইলো।
কারণ আমার দোষ এর সীমা ছিল না – দেখতে নিরীহ, তবু নাকি আমাকে দুর্বিনীত দেখায়, কিংবা নাকি মাঝে মাঝে দেখায় ফেমিনিস্ট এর মতো; ঠিকমতো কথা নাকি শুনি না বা ফোন ধরি না, বা ঠিক ট্যাক্টফুল না; কখনো দোষ ছিল এই যে পেশকার-স্টাফ থেকে ম্যানেজ করে বস মহোদয় গণ এর বৈকালিক নাস্তার আয়োজন এ ঠিক সহায়ক নই, দোষ ছিল মর্জি বুঝে নিয়োগ কমিটিতে অনিয়ম করতে জানিনি … কী জানি আরও কিছু দোষ আমার থেকে থাকবে, – সব বলতেও ইচ্ছে হয় না।
শুধু জানি, সকাল আটটায় কোর্টে যেতাম সবার আগে, ফিরতাম সন্ধ্যায়– রাতে, প্রায়শই সবার শেষে, কখনো কখনো বিদ্যুৎ থাকতো না, মোমের আলোয় কাজ সেরে একজন পিয়ন আর তার টর্চলাইট সম্বল করে নেমেছি, কখনো ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ডাক এর সাথে শিয়ালের ডাক সঙ্গী ছিল। বেশি বেশি কাজ দেয়া হতো আমাকে, করতেও হতো আরও বেশি করে, – যেন আমার দোষ ধরার সীমা নথীতে না পৌঁছায়। অফিসের সরকারি গাড়ি থেকে বঞ্চিত রাখা হতো প্রায়ই (শাস্তি হিসাবে সম্ভবত), ভয়াবহ সব ডাকাতির কিংবা জঙ্গি হামলা’র মামলায় সাক্ষী নিয়ে কিংবা সেনসিটিভ ইলেকশন এর মামলা’র রায় দিয়ে হেঁটে কিংবা রিকশায় বাসায় ফিরেছি… প্রায় প্রতিদিন ফিরতে ফিরতে আল্লাহ, ঈশ্বর সবাইকে একযোগে ডেকেছি, বলেছি – ‘হে প্রভু, আজকের মতো ঘরে একলা থাকা ছোট্ট ছেলেটা’র কাছে আমাকে পৌঁছে দাও’।
৭/
এতোদিনে স্বপ্নরা হত প্রায়। প্রাণপন কাজ ছাড়া বাড়তি আর কোন দেশ ভাবনা করি না, কিংবা নিজের জন্য পড়ার কিংবা স্কলারশিপের খবর নিই না, কেউ দিতে চাইলেও না। জেলাজজ মহোদয় এর অত্যাচার আরও বাড়লো, সে কি ঈশ্বর এর কৃপায়? স্বপ্নগুলো ক্রমশঃ ত্যাগ করে আমি নিঃস্ব প্রায়, কিন্তু ‘মানুষ’ হিসেবে আমার একান্ত ব্যক্তিগত জন্মগত মর্যাদাবোধ, সেটা বিসর্জন দিলে আর মানুষ থাকি কি!
এমন একদিনে যখন দিন রাত্রির ফারাক দেখি না, খবর এলো কানাডায় যেতে হবে। আমি দোনোমোনা করি। তারপর যুদ্ধ নিজের সাথে, পরিবারের আরও নানান জনের সাথে। মাঝে মাঝে বাচ্চাটা কে দেখি, দু-এক বছর বাদেই প্রাক-কৈশোরে পৌঁছাবে সে, সারাদিন সন্ধ্যা রাত অবধি একলা থাকে, মাঝে মাঝে মৌলী মিস ভরসা তার। এছাড়া সঙ্গী হলো টিভি, প্লে স্টেশন এর গেম, কিংবা কম্পিউটার,- বিদ্যুৎ চলে গেলে তাই সে দিশেহারা বোধ করে, গৃহকর্ম-সহকারী লাল খালা জানায়, ছেলেটা আমার মাঝে মাঝে ছুটোছুটি করে বলে – তার নাকি মরে যেতে ইচ্ছে করে। শুনে হিম হয়ে জমে যাই, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই বুঝি শেষমেশ সোজা পথ খুঁজি!
৮/
‘কে তুমি, কী তোমার পরিচয়, কেমন করে ভাগ করো তুমি আনুগত্য, কার প্রতি ভালোবাসা রয়ে যায় কিংবা জন্মে – যে দেশটিকে ফেলে এসেছো তাকে কি ছেড়েছো, যেথায় এলে তাকে কি গ্রহণ করলে… ’ – এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেহুদা একটা কোর্স নিলাম ‘সিটিজেনশিপ এন্ড আইডেন্টিটি’। এমনই পড়লাম যে কোর্সে বোনাস মিলে মার্কস একশতে একশ’র বেশি হয়ে গেল। কতভাবে কানাডা দেশটা চেষ্টা করে যেন নতুন আগন্তুক একজন নিজের ফেলে আসা দেশটাকে ভালবেসেও বুকের ছাতিটা বড় করে কানাডাকে ঠাঁই দেয়, এদেশ এর চার্টার অব রাইটস এ মুগ্ধ হয়ে রই, অনেক উত্তর এর সাথে স্বস্তি পাই, তবু শান্তি মিলে না।
প্রশ্নগুলো আজীবন ‘প্রশ্ন’ থেকে যাবে, সাথে উত্তর খোঁজার প্রাণান্তকর এক চেষ্টাও – ‘নিজেকে বুঝবার, যুঝবার …
সান্ত্বনা- পৃথিবীটা গোল, পরিযায়ী মন পথ ভুলে না।
_____________________________________
বিঃ দ্রঃ এ আমার একান্ত নিজস্ব কথন। প্রায় সবার এমন অথবা অন্যরকম নিজস্ব একটা গল্প আছে। আর আমার প্রাক্তন সহকর্মী অনেক বিচারক আছেন, ভয়ানক কষ্ট করেও দুর্বিনীত রকম নীতিবান থাকেন, অনেকে অনেক কষ্ট সয়েও কাজ করে যান, – তাদের জন্য আমার নিরন্তর শুভ কামনা।