#মি টু: আমাদের সংস্কৃতি এবং বাস্তবতা

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেই যাত্রা শুরু হয়েছিল #মি টু’র! কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপরে যৌন নির্যাতন বিষয়ে সচেতনতা, জনমত, এবং এর সম্মিলিত প্রতিবাদের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করাই মূলত এর উদ্দেশ্য। যা ২০১৭ এর অক্টোবরে মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানোর (হ্যাশট্যাগ) হাত ধরেই প্রথম জনসমক্ষে এসেছিল। সময়ের পালে হাওয়া দিয়ে তা ছড়িয়েও পড়েছে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে, আর সেই যাত্রায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হলে অকপটে বলতে পারবে বাংলাদেশের মাটিতে; এই বোধটি তৈরি হওয়া নিতান্তই জরুরী, যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীকেই আজও সমাজ নিন্দার কাঁটায় ব্যবচ্ছেদ করে!

মি টু’র ফলে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, প্রভাবশালী, ব্যক্তিত্ববর্গের ভেতর ঘরের নোংরাসমূহ লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসবে। সকলেই জানবে প্রভাব-প্রতিপত্তির আড়ালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের যৌনলালসার কথা, বিকৃত রূচির কথা।আমাদের রাষ্ট্র এ বিষয়ে উন্নাসিক থাকলেও যৌন হয়রানি বিষয়ে সামাজিক জাগরণে মি টু একটি বড় ধরনের ধাক্কা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস ছিল।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

#মি টু নিয়ে লিখতে এসেই কিছু প্রশ্ন ভীড় করেছিল মনের কোণে, যেকারণে লেখাটা শেষ করিনি। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া চরম সত্য আর যন্ত্রণার কথা বলবার সাহসিকতা দেখিয়ে কাউকেই কি পাশে পাব? আমার ঘর কি আমায় সমর্থন দেবে? বন্ধু-স্বজন? ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে না এতোসব না লিখলেও পারতেন! কেউ কেউ আবার আমার সেলিব্রেটি হতে চাইবার বাসনাও টের পাবেন এর মধ্য দিয়ে। সেকারণেই #মি টু নিয়ে অভিজ্ঞতা আর ভাবনাকে এক করে কাগজবন্দি করা হয়নি।

সর্বদাই আমরা লক্ষ্য করি, যখনই কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন একদল লোক ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটিকে আরও হাজারবার ধর্ষণ করেন; তাঁদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন জীবিত, মৃত কিংবা জীবম্মৃত মেয়েটিকে। আর সেসব প্রশ্ন প্রকারান্তরেই সামাজিকভাবে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধকে লঘু করে দেয়, ধর্ষকের পক্ষেই জনমত তৈরি হয়। ফলত, আমাদের সমাজে ধর্ষণ সামাজিকভাবে আইনসিদ্ধ। এজাতীয় আলোচনায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশ নেন, এবং এটিই আমাদের সংস্কৃতি! এখানে ভিক্টিম বিচার পায় না, উপরন্তু তাঁর ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয় ধর্ষিত হবার অপরাধ!

এমন যখন বাস্তবতা, সেখানে কোনো মেয়ে তাঁর অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানি বিষয়ক প্রসঙ্গ জনসমক্ষে আনলে খুব সহজেই সেই যন্ত্রণার সারথী মিলবে, এমন আশা করা বাতুলতাই মাত্র। যদিও ইতোমধ্যে অনেকেই এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে লিখেছেন। সেই গুটিকয়েক সহৃহয়বানকে বাদ দিলে মিটু’র অভিযোগ করার পরে সমালোচনার শিকার হবার সংখ্যাই বোধ করি বেশি।

কথা প্রসঙ্গে আজই এক বন্ধু আমায় বললেন, “জানো তো #মি টু করে এখানে অনেকে ফেমাস হয়ে যাচ্ছে আজকাল! আমি খুব কৌতূহলের সাথেই জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা কেমন? জবাব এলো, ওই তো, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে #মি টু করে দিচ্ছে, আর এখন সবাই তাঁকে চিনছে। সেক্ষেত্রে তাঁরা মৃত ব্যক্তিকেও ছাড় দিচ্ছে না। আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, কে সেই মৃত ব্যক্তি, যার নামে মি টু করা হয়েছে?
আমি না জানার ভাণ করে তাঁর মতামত দেবার ক্ষেত্র তৈরি করে দিলাম। ব্যস! তিনি সেই মৃত ব্যক্তির পরিবারবর্গের লজ্জার বিষয়টি নিয়েও কুণ্ঠিত। বলেই চললেন, এতে আর কী হবে? প্রমাণ কি করা যাবে? কেবল নিজেই সেলিব্রেটি হয়ে যাবে, আর সেটাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। সেই মি টু’র অভিযোগকারিনী যে একজন সুবিধাবাদী চরিত্রের, সেকথাও বলতে ভুললেন না।”

প্রসঙ্গত, আমার এই বন্ধুটি পেশায় একজন উচ্চপদস্থ উন্নয়নকর্মী, আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থায় কর্মরত। এই যদি হয় মি টু বিষয়ে তাঁর মতামত এবং অবস্থান; তবে সমাজের অন্যান্য স্তরের অন্য নারীদের কিংবা মানুষদের ভাবনার কী হাল তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।

এহেন মন্তব্য কোনো পুরুষ করলে আমিই তাকে ছাড় দিতাম না। পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্য বলে তাঁর গুষ্ঠী উদ্ধার করতাম! মূলত পুরুষতন্ত্র পুরুষের অবয়বে থাকে না, বাস করে সমাজের দেহে-মননে-মগজে! পুরুষতন্ত্রের সাথে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শ্রেণী বৈষম্যের যে সহ-সম্পর্ক রয়েছে তার প্রভাবেই ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষে থাকা নারীর আচরণেও ভিন্নতা দেখা যায়। হয়তো সেকারণেই, আমাদের সমাজের উচ্চবিত্ত, সুবিধাপ্রাপ্তা নারীদের নারীর স্বাধিকার আন্দোলনের চেঁচামেচি শেষতক প্রান্তিক নারীদের জীবনে খুব বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে অক্ষম।

আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, পুরুষতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমরা একদল আরেক দলের প্রতিপক্ষ বনে যাই নিজেদেরই অজান্তে। খুব ভালো বন্ধুও মুহূর্তেই শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়। ফলত, সমাজের প্রচলিত কাঠামোয় নারী-পুরুষের ভূমিকা, রীতি-সংস্কার, ও সমাজ বাস্তবতা নিয়ে আলোচনাগুলো রয়ে যায় একপেশে, একপাক্ষিক।

বস্তুত এই চিত্র হওয়া উচিত ছিল উল্টো। একটি সচেতন, সুন্দর মানবিক সমাজ বিনির্মানের জন্য নারী-পুরুষের সহাবস্থান, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। আর সেক্ষেত্রে, আমাদের শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে আমরা যারা সুবিধাপ্রাপ্ত আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে। যৌন হয়রানির মতো একটি জঘণ্য অপরাধকে আর সামাজিক প্রচ্ছন্ন ছায়ার আড়ালে লালন করতে দেওয়া উচিত নয়। এই বিষয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আইনী জটিলতা দূরীকরণসহ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ক নতুন আইন প্রণয়ন করে সামগ্রিকভাবেই সামাজিক প্রতিরোধ এবং সামাজিক ঘৃণা তৈরি করাটা এখন সময়ের দাবি।

আমাদের সমাজে যখন বৌ-শাশুড়ির মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়, তখন পরিবারের পুরুষ কর্তা-ভ্রাতাগণ খুবই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে এই তিক্ততা নিয়ে তির্যক মন্তব্য করে থাকেন, যা কিনা এই দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখতে সহায়তা করে। অপরপক্ষে, এই সমস্যার মূল উৎপাটনে নারীর নিজের ভূমিকা নারী নিজে কখনোই বুঝতে পারেন না। কাক কাকের মাংস খেতে পারে না, নারীরাই নারীর শত্রু! এমন মন্তব্যে আপাতদৃষ্টিতে পুরুষেরা লাভবান হলেও দিনশেষে এর মূল্য দিতে হয় পরিবারকে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানে, সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ গঠনে এই ঈর্ষার সম্পর্ক পরিবারের পরিসর থেকে বেরিয়ে একদিন সমাজেও ছড়ায়!

সুতরাং, পুরুষতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য প্রপঞ্চগুলোকে নিয়েও কাজ করতে হবে। আমার নিজের জীবনে কোনো সমস্যা হয়নি বলেই সমাজের আর দশজন মেয়েও আমারই মত শৈশব-কৈশোর পেয়েই বেড়ে উঠেছে এমন ভাবনাটা নেহায়েত অমূলক! সুবিধা লোটার জন্য সমাজে যেমন কিছু মানুষ সবসময়ই থাকে, সেই মানুষদের মধ্যে নারীও থাকতে পারে এটা অসত্য নয়। কিন্তু কোনোরকম সত্যতা ছাড়াই শুধু নিজেকে ফেমাস করার লক্ষ্যে কেউ মি টু করবে, এমনটা ভাবতে কেনো জানি কষ্ট হয়!

সামগ্রিক লড়াইয়ের স্বার্থে আমাদের শিক্ষা, রুচি, মেধা-মনন দিয়ে আমাদের বিচারবুদ্ধিকে আরও শাণিত করা দরকার। বৃহৎ অর্জনের অংশীদার হতে একুশ শতকের এই পৃথিবীতে মানুষ হয়েই পাশে থাকি মানুষের! মেয়ে শিশু-নারী শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচুক, ভয়হীন পৃথিবীতে!

আগামীর বিশ্বকে গড়ার তাগিদে মানুষ হয়ে উঠুক মানুষের শঙ্কাহীন অন্তিম আশ্রয়!
যৌন নির্যাতনকারী যে ই হোক, যত ক্ষমতাধরই হোক, সকলে মিলে রেখে যাই এক দঙ্গল ঘৃণা তাঁদের জন্য! করি সমস্বরে প্রতিবাদ! হোক প্রতিরোধ! এভাবেই বদলাবে সমাজ! সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যাবে একটি বাংলাদেশ।

#MeToo
#MeTooBangladesh

টরন্টো, কানাডা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.