আমার সন্তান কি বুঝবে আমাকে?

ফাহমিদা নীলা:

-বাবা,তুমি জুতা না পরে স্যান্ডেল পরেছো কেন এই ঠাণ্ডায়?
-তো কি হবে মা?
-কী হবে মানে? ঠাণ্ডা লাগবে! এরপর শীতের মধ্যে যদি আমি তোমাকে জুতা-মোজা ছাড়া বেরুতে দেখি….!
-তাহলে?
-তাহলে তোমার একদিন কী আমার একদিন!
-উফফ মা! সবারই তো একদিন হবে!

আমার ছেলের এই একটা ডায়ালগ আমাকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দিল, ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত। সত্যিই তো! সবারই একদিন হবে। আমারও হবে একদিন৷ যেদিন আমার সন্তান আমাকে নতুন পোষাকে সাজিয়ে বিদায় দেবে। সেদিনটা তো শুধু আমারই হবে। এরপর কিছু না থাকলেও প্রতিবছর আমার ঐ একদিনটা থাকবে। সারা বছর না হোক,ওই একদিনে আমার সন্তান আমার স্মৃতি হাতড়াবে। হয়তো সেই একদিন ও বুঝতে শিখবে, মাকে ও কত ভালোবাসতো! কিংবা মা ওকে কত ভালোবাসতো?

ফাহমিদা নীলা

ও তো জানে না,মা তাকে সেদিন থেকেই কোন কারণ ছাড়াই ভালোবেসেছিল, যেদিন ওর অস্তিত্ব কেবল সীমাবদ্ধ ছিল ক্রমাগত বিভাজিত কিছু কোষের মধ্যে। তাকে ধারণ করার প্রতিবাদে বিদ্রোহে জেগে উঠেছিল মায়ের শরীরের অন্যান্য সকল কোষ। শুরুটা কোন কোষ করেছিল তা জানা না গেলেও প্রথম আঘাতটা হেনেছিল পরিপাকতন্ত্র । দেহে অজানা কোষ ধারণের প্রতিবাদস্বরূপ প্রথম অনশন ধর্মঘট ডেকেছিল পাকস্থলী। ঠিক কতদিন অন্নের দানাটুকুও গ্রহণ করেনি সে, তার হিসাব কেউ রাখেনি। বেহায়া মা’টাও না।

জন্ম থেকে বয়ে বেড়ানো কোষগুলোকে দিব্যি অবজ্ঞা করে অজানা,অচেনা কয়েকটা কোষকে আদরে-আহ্লাদে জরায়ুতে ধারণ করেছিল যে মানুষটি, সেই মা। যার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি তাকে ক্ষমা করেনি, অবজ্ঞা আর অবহেলার অপরাধে।

পরিপাকতন্ত্র থেকে শুরু করে একে একে শরীরতন্ত্রের সকল অঙ্গ যার অপরাধের মাসুল বুঝিয়ে দিয়েছিল কড়ায়-গণ্ডায়। কোষে কোষে জমেছিল অতিরিক্ত পানি, চোখের নিচে পড়েছিল কালি, মুখমণ্ডল জুড়ে ছোপ ছোপ কাল দাগ, যত্রতত্র চামড়া ফেটে দগদগে লালচে রেখা, শরীর জুড়ে যখন-তখন তীব্র চুলকানি, আঙুলের হাঁচড়ে উঠে আসা অসংখ্য চুল বারংবার তীব্র প্রতিবাদে জানিয়ে দিয়েছিল, তুমি নিজেকে ভুলে অচেনা কাউকে আপন করে নিয়েছো, যাকে তুমি দেখোনি আজও। ধীরে ধীরে নিজের পা দু’খানি গতি কমিয়ে প্রতিটি ধাপে যাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, নিজের বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত বহন করছো তুমি। যার কোমরের হাড়গুলো ঘুমের মধ্যে কাত ঘোরার সময়ও ঝাঁকিয়ে তুলে জানাতে ভুলেনি, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ধারণ করেছো তুমি। সব, সব উপেক্ষা করে শুধু তাকেই ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, সেই মা।

যার শরীরের রক্ত আর পুষ্টি শুষে এক বিন্দু রক্ত থেকে একটা মানুষের আকৃতি নিয়েছিল সে, সেই মা।
পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে আসার মত আদল আর শক্তি অর্জন করে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য যার জরায়ুকে সে তীব্রভাবে আলোড়িত করেছিল,সেই মা।

আচ্ছা, সে কি অনুভব করতে পারবে, তার এক একটি আলোড়নে জাগানো ব্যথা একসাথে বিশটি হাড় ভাঙার সমতুল্য যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছিল? বারো ঘন্টার সেই তীব্র যন্ত্রণাদগ্ধ লড়াইয়ে যে তার মা প্রথম মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করেছিল, সে কথা আমার ঐ একদিনে আমার সন্তানের মনে হবে নিশ্চয়!

ভয়ানক যুদ্ধ শেষে আমার শরীরের অনেকগুলো কোষ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে সে যখন জন্ম নিল, হঠাৎ করে আমার শরীরটা হালকা হয়ে গেল। তার সুতীব্র আগমনী চিৎকারে এক মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম ন’মাস লড়াইয়ের ছোট-বড় সকল যুদ্ধস্মৃতি। আমি যে বেহায়া মা! ও কি বুঝবে সে কথা?

আচ্ছা, ওর কি মনে পড়বে ওকে প্রথম দেখার জন্য সবাই যখন হুটোপুটি করে ভীড় জমাচ্ছিল, উৎসুক নয়নে দেখে ওর বাবার সাথে চোখ-নাক-মুখের সাদৃশ্য খু্ঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখনও ওর মা ক্ষতবিক্ষত অঙ্গটা ডাক্তারের সূঁচের নিচে অসহায়ের মতো পেতে প্রতিটি ফোঁড় উপলব্ধি করেছিল লোকাল এনেস্থেসিয়ার অ্যাকশন ছাপিয়ে? সুনিপূণ সেলাইয়ের প্রতিটা গিঁটের বাঁধন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলেও কান খাড়া হয়েছিল ওর কন্ঠধ্বনির শোনার আকাঙ্খায়। সে স্মৃতি কি ওকে নাড়া দেবে?

তার পরের প্রতিটি জেগে থাকা রাত, প্রতিটা এলোমেলো মুহূর্ত সে নিশ্চয় তাদের সন্তানের মাঝে দেখতে পাবে! ঠিক কত রাত সে তার সন্তানের জন্য ঘুমাতে পারে না, কতোগুলো দিন তার সন্তানের জন্য ব্যয় করে, তার হিসেব করবে না নিশ্চয়! যেমনটা এখন করে মায়ের জন্য।

-উফফ মা, তুমি আমার সকালটাই মাটি করে দিলে!
-ধুর মা, তোমার জন্য আজকের বিকেলটাই নষ্ট হয়ে গেল!
-ইস্ মা! সারাটা রাত তোমার নাক ডাকার অত্যাচারে ঘুমাতেই পারিনি।
-ছিঃ মা, আজকের সন্ধ্যেটা এভাবে না জ্বালালেও পারতে!

আমি তো বেহায়া মা! আমি হিসেব করি না। ঠিক কত রাত আমার পায়ের উপর শুইয়ে পা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে তোমাকে আরামের ঘুম দিতে নির্ঘুম কাটিয়েছি? আমার মনে পড়ে না। ঠিক কতদিন তোমার জন্য সময়মতো খেতে পারিনি? আমার হিসেব নেই। ঠিক কতবার তোমার পছন্দের খাবারটা হা করা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে টিস্যুতে মুড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে ব্যাগে ভরে চুপ করে বাসায় নিয়ে এসেছি, আমার মনে নেই।

আমি হিসেব কষিনি তোমার জন্য ব্যয় করা সময়ের, রক্তের, কষ্টের কিংবা যন্ত্রণার। আমি কেবল স্বার্থপরের মতো হিসেব করেছি আমার শিক্ষার, আমার দীক্ষার আর তোমার সময়ের। তোমার সময়টা যেন হেলায় না ফুরায়, তাই তোমাকে বারংবার বাঁধা-নিষেধ আর নিয়ম-নীতির বেড়াজালে আটকে রেখে স্বৈরাচারী হয়েছি, অত্যাচারী হয়েছি, হয়েছি নির্লজ্জ,বেহায়া।

তবু আজ মনে হলো, আমারও একদিন হবে। যেদিন আমার সন্তান তার বেহায়া মাকে ক্ষমা করে দেবে। ঐ একদিন নিশ্চয় আমার সন্তান বুঝবে, তার সময়ের মূল্য যথাসময়ে বোঝাতেই তার মা নিজের অমূল্য সময়গুলোকে গলা টিপে হত্যা করেছিল। দিন, ক্ষণ, ঘন্টার হিসেব করেনি। কোন একদিন আমারও সেই একদিন আসবে। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় দিন গুনি। কারো না, সেদিন হবে শুধু আমার একদিন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.