কাবেরী গায়েন:
১। এতোকিছুর দরকার ছিলো না। নেই নেই করেও গত দশ বছরের আওয়ামী আমলে দৃশ্যমান ভৌত উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছিলো। সব বাদ দিলেও মেগা প্রজেক্টগুলোতে হাজারও মানুষের কর্ম সংস্থান হয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দলের অবস্থান ভালো ছিলো। পোক্ত নির্বাচনী ইশতেহার ছিলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গৌরব ছিলো।
পাশাপাশি বিএনপি’র দলগত অবস্থান ছিলো খুবই দুর্বল। নেতারা কারাগারে, নির্বাচনী প্রচার নেই বললেই চলে, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে চরম হতাশা, সব মিলিয়ে বিএনপি’র অবস্থা এবারের নির্বাচনে জেতার জন্য অনুকূলে ছিলো না। গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতি সত্ত্বেও তাই আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের সম্ভাবনাই প্রবল ছিলো নির্বাচনে জেতার। যে ব্যবধানে জিততো, সেটা শোভন হতো।

আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা দিনের তিন অংশে পৃথকভাবে ছিমছাম পরিবেশে ভোট দিয়ে আসলে খুশিই ছিলাম। কেন্দ্র ছিলো ঢাকা সিটি কলেজ। পরে একে একে যা বের হয়েছে, হচ্ছে ঝুলি থেকে, তা দেখে বুঝতে পারছি ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের উপর আস্থা ছিলো না। নিজের প্রতি এই আস্থাহীনতার সংকট থেকে যে নির্বাচন তারা করেছে, তার সাথে জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ/না ভোট, কিংবা ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে যে নির্বাচন হয়েছিলো তেমন কিছুরই বুঝি তুলনা চলে। দুই সেনাশাসকের নিজেদের বৈধতা দেবার জন্য যে নির্বাচনী খেলা, তার সাথে যদি মিল পাওয়া যায় এই দেশের সবচেয়ে পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের, তবে কে হারে? হারে এদেশের রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা, লড়াই আর আত্মত্যাগ।
২। নোয়াখালির সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবিলী ইউনিয়নের মধ্যবাগ্যা গ্রামে ‘ধানের শীষে ভোট দেবার অপরাধে’ রোববার রাতে এক মধ্য়বয়সী নারীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করার অভিযোগ পেয়েছি আমরা গণমাধ্যমে। অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। কোনভাবেই যেনো এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব না হয়। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তি/ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। সরকার এই ঘটনার বিপরীতে কী ব্যবস্থা নেয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছি। দৃষ্টি সজাগ রয়েছে সারা দেশের।
৩। ভোটার সংখ্যার চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে মর্মে খবর প্রকাশের অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের খুলনা বিভাগীয় প্রতিনিধি হেদায়েৎ হোসেনকে। একই অভিযোগে দৈনিক মানবজমিনের খুলনা প্রতিনিধি রাশিদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে৷ মামলাটি দায়ের করেছেন খুলানার বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী৷ মামলাটি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
প্রথম কথা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির উদ্দেশ্য যে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, এই কথাটি বলতে গিয়ে মূল্ধারার গণমাধ্যমে কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছি, সে’কথা আরেকদিন না হয় বলা যাবে বিস্তারিত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার আশংকাই সত্য প্রমাণিত হলো। এই বিতর্কিত আইনে কাউকে গ্রেফতারের নিন্দা জানাই।
দ্বিতীয়ত, যদি এই দুই সাংবাদিক মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন, তবে সঠিক তথ্য সরবরাহ করে তাঁদের দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট। রিমান্ডে কেন? রিমান্ডে নিয়ে আসলে শাস্তি দেয়া যায় না কোনো সাংবাদিককে। বরং মিথ্যা তথ্য হলে (যদি হয়) দুঃখ প্রকাশই হতে পারে প্রকৃত শাসন। ডান্ডাবেরি, হামলা-মামলা তুলে রাখুন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, উপরন্তু যারা ভোট দিতে গিয়েছেন তাদের উপর যে নির্যাতন করেছে বিএনপি-জামাত জোট, সেই নির্যাতন ও সহিংসতার উপর নির্বাচনী বৈধতা তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের অনেকখানিই। দিনাজপুরের কর্ণেই, গড়েয়া আর ঠাকুরগাঁও পরিদর্শনের কথা মনে করে আজও বিষাদ্গ্রস্ত হই।
কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। আওয়ামী লীগ এবার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা প্রতিশ্রুতির তোয়াক্কাই করেনি। সেইসাথে যদি ধর্ষণ আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে, তবে পরিস্থিতি খুব সুখকর হবে না, বলাই বাহুল্য। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।