ইনফার্টিলিটি কি শুধুই নারীর?

শিল্পী জলি:

বাংলাদেশী নারীর বিবাহিত জীবনের আনন্দ-আহ্লাদ এবং ঘোরের সময় অতি কম। বরং বলা যায় বিয়ে হতেই অনেকেই কল্পনার রাজ্য ছেড়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। একদিকে হাজারও দায়িত্ব নেমে আসে কাঁধে, অন্যদিকে চলে চরিত্রের নানামুখী চুলচেড়া বিশ্লেষণ। স্বামী, স্বামীর পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের মন রক্ষা করতে গিয়ে অনেকেরই নিজের দিকে আর চাইবার সুযোগ হয় না।

তথাপি কি মন রক্ষা করা যায় সবার? পান থেকে চুন খসতে না খসতেই শ্বশুর বাড়ি থেকে বদনাম পৌঁছে যায় বাপের বাড়ি। সেখানে যদি বিয়ের পর কোনো দম্পতির বাচ্চা না হয়, তাহলে শতভাগ দোষ গিয়ে পড়ে মেয়েটির উপর। এমনকি এই সুবাদে কারও কারও আবার তালাকও হয়ে যায়। কোনো কোনো স্বামী আবার আরেকটি বিয়ের খোঁজ করা শুরু করে। খুব কম পরিবারই আছে, যারা এই পরিস্হিতিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই ডাক্তার দেখিয়ে পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেয়। মুক্ত এবং নিরপেক্ষ থেকে বিষয়টিকে সমাধানের চেষ্টা করে। শুধু নারীর অক্ষমতাই কি সন্তান জন্মদানের অক্ষমতার একমাত্র কারণ?

সন্তান জন্মদানে অক্ষম (ইনফার্টিলিটি) দম্পতিদের এক তৃতীয়াংশের বাচ্চা হয় না পুরুষের ইনফার্টিলিটিজনিত কারণে, যদিও এখনও আমাদের সমাজ সেটি ভাবতে শেখেনি। নারীর অক্ষমতাকে নারী এবং সমাজ যতটা পজেটিভলি হ্যান্ডেল করে, পুরুষের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টা। নারীর জীবনে হাজারও দুর্বলতা বা দোষ বা কটাক্ষ হজম করা কোন বিষয়ই নয়। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে যেনো কোন দুর্বলতাই থাকতে নেই। সে যেন কোন মানুষই নয়– দোষ/ত্রুটিহীন শুদ্ধ সমৃদ্ধ জীবন তার। কোন অপূর্ণতাই থাকবে না তার জীবনে। আর থাকলেও টুঁ শব্দটি করার অনুমতি/রীতি চালু নেই সমাজে। ফলে অধিকাংশ বাংলাদেশী ছেলেই সহসা কোন দায় বহন করতে বা নিতে শেখে না। এমনকি ডিভোর্স করতে গিয়েও তারা অকারণ নানামুখী বানোয়াট দোষ চাপায় মেয়ের কাঁধে– চরিত্রের দোষ, মাথার দোষ, আরও কত কী খুঁজে বের করে, যেন নিজে একেবারে ধোঁয়া তুলসীপাতা প্রমাণিত হয়। অথচ মানব চরিত্রের এতো বিশুদ্ধতা মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের পথে চরম বাঁধা, যা মানুষকে আর মানুষ থাকতে দেয় না।

জীবনযাপনের পথে নারীর যেমন হাজারও সমস্যা থাকবে, তেমনি পুরুষেরও। উভয়ের জন্যেই দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় নির্ধারণই সঠিক পদক্ষেপ। সন্তান না হলে শোনা যায় পুরুষের একাধিক বিয়ের খবর। কিন্তু পুরুষের ইনফার্টিলিটি বা সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার কাহিনী খুব কমই শোনা যায়। নারী যদি যেকোনো অক্ষমতারই দায় বইতে পারে, তাহলে পুরুষ কেন শিখবে না কোন দায়ই নিতে? দু’জনার টিমে কে উপরে, কে নিচে সেটা নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে সমস্যা সমাধানের ফোকাসই কি উত্তম পন্থা নয়?

আজ নারীর অক্ষমতার দিকে নয়, সন্তান জন্মদানে পুরুষের কী ধরনের সমস্যা হতে পারে এবং কীভাবে সেটা হ্যান্ডেল করা হয় সে বিষয়ে লিখবো।

সন্তান জন্মদানে সচেষ্ট দম্পতিদের বার মাসেও যদি গর্ভধারণ না ঘটে তাহলে নারীপুরুষ দু’জনেরই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা সমস্যা নির্ধারণ করে সমাধান পেতে। এক্ষেত্রে ডাক্তার পুরুষকে প্রথমেই যেই পরীক্ষাটি করিয়ে নিতে পরামর্শ দেন, সেটি হলো সিমেন এ্যানালিসিস।

ছেলেদের সিমেন এ্যানালিসিস বা স্পার্ম কাউন্ট টেস্টে এর পরিমাণ এবং গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। সেক্সে অর্গাজম ঘটলে যে সাদা ঘন তরল নির্গত হয়, সেটাকে বলে সিমেন। আর এর মধ্যে জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বহনকারী যে সেল বা মেটেরিয়াল থাকে সেটিকে বলে স্পার্ম। সিমেন বা স্পার্মের যে কোন ধরনের সমস্যা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বাঁধা তৈরি করতে পারে, যার হয়তো চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে।

সিমেন এ্যানালিসিস টেস্টে প্রথমেই যে বিষয়টি আসে সেটি হলো সিমেনের কালেকশন কীভাবে করতে হয়?
সাধারণত ক্লিনিক বা স্বাস্হ্যকেন্দ্র কালেকশন কাপ (Sterile) সরবরাহ করে। হয় ক্লিনিকে বা বাসায় কোন রকম লুবরিকেন্ট ছাড়া মাস্টারবেট করে সিমেন কালেক্ট করতে হয় ঐ কাপে রুম টেম্পারেচারে। বাসায় কালেক্ট করলে এক ঘন্টার ভেতরে স্যাম্পল ক্লিনিকে পৌঁছাতে হবে। কালেকশনের আগে স্যাম্পল যেনো সর্বোচ্চ পরিমাণ হয় তাই ২ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত কোন সেক্স, মাস্টারবেশন, বা ইজাকুলেশন (সিমেন নির্গত/বের হওয়া) নিষেধ। তবে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সিমেন জমিয়ে রাখাও বারণ। কেননা তখন গুণগত মান হ্রাস পেতে পারে।
মাস্টারবেশনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাঁধা থাকলে অনেক সময় ক্লিনিক স্পেশাল ধরনের কনডম সরবরাহ করে থাকে, সেইক্ষেত্রে স্ত্রীর সাথে সেক্সের সময় স্যাম্পল কালেক্ট করতে বলে। কালেকশনের পর সিমেন স্যাম্পলের মাইক্রোসকপিক টেস্ট করা হয়। দেখা হয় পরিমাণ, স্পার্ম কাউন্ট, স্পার্মের আকার-আকৃতি, মুভমেন্ট, হোয়াইট ব্লাড সেল কাউন্ট ইত্যাদিসহ আরও নানাবিধ দিক।

নরমাল রেজাল্টে সিমেনের পরিমাণ বা ভলিউম হতে হবে কমপক্ষে ১.৫ মিলিলিটারস বা হাফ টি স্পুন সমান। এর কম হলে মনে করা হয় সিমেনাল ভ্যাসিক্যালস পর্যাপ্ত ফ্লুইড তৈরি করছে না কোন ব্লকেজ, প্রস্টেট সমস্যা বা অন্য কোন কারণে। তাছাড়া প্রতি মিলিলিটার সিমেনে কমপক্ষে ১৫ মিলিয়ন সংখ্যক স্পার্ম থাকতে হবে। উল্লেখ্য যে ১০ লক্ষে এক মিলিয়ন (বিশাল ব্যাপার)। শুধু তাই নয়, এর ৫০% বা তারও বেশি স্পার্ম সঠিক পদ্ধতিতে চলমান থাকতে হবে যাকে বলে মটিলিটি। এখানেই কি শেষ? আরও আছে। কমপক্ষে ৪% স্পার্মের নরমাল সেইপ থাকতে হবে। স্পার্মের মাথা, ঘার, এবং লেজ দেখে সেইপ বা মরফোলোজি যাচাই করা হয়।

স্পার্মের সেইপ এবং মুভমেন্ট ঠিক না থাকলে স্পার্ম চলে আঁকাবাঁকা–এগের সাথে মিলন ঘটিয়ে এমব্রিয় (ভ্রুণ) তৈরি করতে সক্ষম হয় না, তখন অর্থাৎ গর্ভধারণ ঘটে না। হোয়াইট ব্লাড সেল কাউন্টও দেখা হয় যাচাই করতে যে পুরুষের শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কিনা, যা সন্তান ধারণে বাঁধা হিসেবে কাজ করছে।

অনেক সময় সার্জারিজনিত ত্রুটির কারণে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন ঘটতে পারে, তখন সিমেন বাইরের দিকে নির্গত না হয়ে ব্যাক ফ্লো হয়ে (পেছনের দিকে) ব্লাডার বা মুত্রথলির/মুত্রাশয়ের ভেতরে নির্গত হয়। এক্ষেত্রে পুরো সিমেনেরই সাড়ে সর্বনাশ, একেবারে মুত্রজলে পতিত– কিসের প্রেগনেন্সি!

আরও যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তাহলো সিমেনের PH লেভেল। পিএইচ লেভেল ৭.১ থেকে ৮ এর মধ্যে থাকতে হবে। এর কম হলে এসিডিক, বেশি হলে ক্ষার জাতীয় সিমেন। এমন হলে স্পার্মের স্বাস্হ্য এবং মুভমেন্ট ঠিক থাকবে না ঐ সিমেনের ভেতরে।

লিকুইফিকেশন টাইম বলেও একটি বিষয় আছে সিমেনের। সেক্স শেষে অর্গাজম ঘটলে যে নির্গমণ বা নিঃসরণ (সাদা তরল পদার্থের) ঘটে তাকে বলে ইজাকুলেশন। ইজাকুলেশনের সময় সিমেন থাকে অতি ঘন। বিশ মিনিট পর এটার পাতলা হবার কথা। কারও কারও ক্ষেত্রে এটা পাতলা হতে বেশি সময় নেয়। কারও ক্ষেত্রে হয়তোবা একেবারেই পাতলা হয় না। সমস্যার কথা।

আবার কারও ক্ষেত্রে এমনও হয় সিমেন আছে ঠিকই, কিন্তু সিমেনের ভেতরে কোন স্পার্ম নেই। ভ্যাসেকটমির সফলতা বিচারের জন্যে এই রেজাল্ট কাক্ষি্খত হলেও গর্ভধারণের জন্যে নয়। এমতাবস্হায় চেক করা হয় টেস্টিক্যালস থেকে পিনাস পর্যন্ত কোন বাঁধা বা ব্লকেজ আছে কিনা, যা শুক্রাণুর অনুপস্হিতির কারণ হিসেবে চিনি্হত হতে পারে!

অনেক সময় টেস্টিকেলসের (বলস) উপরে অস্বাভাবিক ভেইনের ফরমেশন হয় যখন সার্জারির প্রয়োজন। আবার কখনও কখনও এমনও হয় যে মেইন স্পার্ম পাইপ লাইনই (The vas deferen /নালী) হয়তো থাকে না, যা জেনেটিক সমস্যা। কখনওবা শরীরে এ্যান্টি স্পার্ম এ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা স্পার্মকে আক্রমণ করে ভ্যাজাইনাল ক্যানেলে এগের সাথে মিলনের পথে। নানাবিধ যাচাইবাছাই শেষে ডাক্তার যখন লো স্পার্ম কাউন্টের কোনই কারণই ধরতে পারেন না, তখন বলে দেন, তোমার ইডিওপ্যাথিক ইনফার্টিলিটি। অর্থা বলা গেল না কী কারণে এই ইনফার্টিলিটি বা সন্তান জন্মদানে অসফলতা।

নানাবিধ অসুখও রয়েছে যা অনেক সময় কারণ হতে পারে। হরমোনাল সমস্যা বা লো টেসটস্টরোনের বিষয়ে দেখা গিয়েছে যে ৯৭% ক্ষেত্রে এটা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করে না।

সে যাইহোক, শতকরা পঁচিশ থেকে ত্রিশ ভাগ দম্পতি সন্তান ধারণে অক্ষম– সংখ্যাটি কম নয়। এক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে দু’জনারই সমস্যা থাকতে পারে। বিষয় ওটা নয়। বিষয় হলো বিয়ের আগেই নিজেকে জানা, যাতে করে সচেতন পদক্ষেপ নেয়া যায়। অবস্হা বুঝে সঠিক পাত্রপাত্রী বাছাই করা সম্ভব হয়। বিয়েতে সন্তান অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আর শুধু নারীরই অক্ষমতা একমাত্র কারণ নয় যে অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় সন্ন্যাসী বা হুজুরের পানি পড়া খেলেই গর্ভধারণ ঘটে যাবে। এই পানিপড়া সেই পানীয়ও নয় যে পানযোগ্য।
উপরন্তু এতে গর্ভধারণ ঘটলেও সেটা নিজের বংশধর নয়, হাওলাতের– হুজুর বা তার সাঙ্গপাঙ্গের বংশধর। অথচ ডাক্তারের কাছে গেলে হয়তো ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমেই নিজের বংশধর স্ত্রী’র গর্ভে স্হাপিত হতো। আবার স্ত্রী’রও নিরাপত্তা থাকতো।

স্বামী-স্ত্রী’র মাঝে খোলামেলা আলোচনা এবং আন্তরিকতায় উভয়েরই লাভ বই ক্ষতি কম।

শেয়ার করুন: