“অতিথি ও এঁটো থালা”

সুমিত রায়:

কারোর বাড়িতে খাওয়ার পর এঁটো থালা তুলতে গেলে সেই বাড়ির লোকেরা সব হা হা করে উঠে, “আরে এ কী করছেন! এমা! ছি! ছি! রাখুন, রাখুন। একদম হাত দেবেন না। উঠুন, উঠুন, উঠে পড়ুন।”
এটা আমাদের আতিথেয়তার একটা অঙ্গ।

এখন মনে করুন এই কথাটি বাড়ির নারী সদস্যটি বললো। তাহলে কথাটার মানে হলো, “এমা! আপনি থালা ধোবেন কেন! ওগুলো আমি মাজবো।” আর ঠিক এই একই কথা যদি বাড়ির পুরুষ ব্যক্তি বলে তাহলে তার মানে হলো, “এমা! আপনি থালা ধোবেন কেন! আমার স্ত্রী আছেন কী করতে?”

অতিথি বাড়ি এসে নিজের এঁটো থালা ধোবে এটা অতিথির পক্ষে খুবই অপমানজনক বলেই আমরা মনে করি। আমরাও কারোর ঘরে নেমন্তন্ন খাওয়ার পর যদি এঁটো থালা ধুতে হয় তাহলে লজ্জায়, অপমানে বোধ হয় আমরা আত্মহত্যা করবো।

কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বাড়িতে গেস্ট এলে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা এক্সপেক্ট করি যে তারা নিজের থালা নিজে ধুয়ে রাখবে। কিন্তু কেউ এটা স্বভাবিকভাবেই করে না। আমরা তো আর বলতে পারি না, “যান, নিজের থালা নিজে মেজে নিন।”

আমার বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই। বাড়ির কাজ দুজনে শেয়ার করেই করে থাকি। রাতে যেহেতু আমি ফ্রি থাকি, তাই বাসন মাজার দায়িত্বটা আমি সামলাই। বাড়িতে গেস্ট এলে সবাই একসাথেই খেতে বসি। খাওয়া শেষ হলে আমি আমার আর আমার স্ত্রীর থালা দুটো গেস্টদের সামনেই মেজে ফেলি। গেস্টরা তখন কেমন একটা হকচকিয়ে যায়। যদি আমার স্ত্রী থালাগুলি মাজতো, তাহলে সেটা ওদের নজরেও আসতো না। কিন্তু বাড়ির পুরুষ মানুষ থালা মাজছে দেখে তারা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করতে শুরু করে। কিন্তু তাই বলে বলতে তো পারে না যে, “তুমি মাজছো কেন, তোমার বউকে দাও।” তাই চুপ করে বসে থাকে, আর নিজেদের এঁটো থালাগুলি ঠিক কী করবে এমন ভেবে চরম দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে।

ঠিক সেই সময় আমি আর অপেক্ষা না করে ওঁদের থালাগুলোও টেবিল থেকে তুলে নিই। অমনি ওঁরা তীব্র আপত্তি জানাতে শুরু করে, “আরে, আপনি হাত দিচ্ছেন কেনো। আমরা ধুয়ে দিচ্ছি।” কিন্তু আমি জানি, আমার স্ত্রী থালাগুলি তুললে ওঁরা একথা বলতেন না। যাই হোক, গেস্ট বলে কথা। তাই তাঁদের সুযোগ না দিয়ে আমি মেজে ফেলি থালাগুলি। ভীষণ অপমানিত বোধ করেন তাঁরা বুঝতে পারি।

কিন্তু কিছু করার নেই। তারা হয়তো তখন আশা করেন যে আমার স্ত্রী তখন ছুটে এসে বলবেন, “আরে আমি মেজে দিচ্ছি তো!” কিন্তু তেমন কিছুই ঘটে না। স্ত্রী তাঁর কাজ করতে থাকেন, আমি আমার কাজ। আর এদিকে গেস্টরা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, জীবনে আর আমার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে আসবেন না।

লেখক:
সুমিত রায়, কল্যাণী, পশ্চিমবঙ্গ

শেয়ার করুন: