আত্মঘাতী নই, স্বপ্নবাজী হই, পৃথিবীটা স্বপ্নবাজদেরই

শাহরিয়া খান দিনা:

জাগতিক এই জীবনে এমন অনেক সময়ের সম্মুখীন হই আমরা যখন চেনাজানা পৃথিবীটা খুব অচেনা লাগে। পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর একভাগ স্থলের মতই চারদিকে অসীম শূন্যতার জলরাশি, মাঝখানে আমি। একাকী। নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মতো একা। দূরে নীলগ্রহের সব সুখী মানুষ অথচ আমার একলার জগত। মনে হয় কেউ আমাকে বুঝতে চায় না, কেউ খোঁজ নেয় না। সত্যি কি তাই? নাহ! আসলে আমরা সবার বুঝতে চাওয়া, খোঁজ নেবার আশা করি না। করি বিশেষ কারো জানতে চাওয়ার অপেক্ষা, বুঝবার প্রত্যাশা। সেটা হতে পারে আমাদের বাবা-মা, পরিবার, প্রিয়জন অথবা বন্ধুবান্ধব।

ঘর তুলতেই মাথার উপর ছাদ, ঘর না তুললে পুরো আকাশটাই যেমন আমার। ঠিক তেমনি সব মানুষের মধ্য থেকে যখন কাউকে নিজের মানুষ ভাবতে থাকি, আপন করে চাইতে থাকি তখনই সেই মানুষটাকে আমার ভালো লাগা-মন্দলাগা’র ঠিকাদারী দিয়ে দেই নিজের অজান্তেই। যে আমার ভালো থাকার কারণ, সেই আমার মন্দ থাকার উপলক্ষ্য। যার জন্য হাসিমুখ তার জন্য অশ্রু-সজল।

মাথার উপর আকাশ নিয়ে চলতে থাকা ছোট্ট মানুষটা বড় হতে শুরু করে। বয়ঃসন্ধী নামক সময়ে পৌঁছে এ সময়ে কেউ কেউ আবিস্কার করে কেউ তাকে বুঝতে চায় না, পারে না। সারাজীবন স্কুল কলেজে একা থাকা অনেক ছেলে মেয়ে ভার্সিটি লাইফে এসে জিএফ/বিএফ বানানোর প্রক্রিয়ায় চলে যায়। এটা বানানোর মতো কোন প্রক্রিয়া নয়, বরং হয়ে যাবার মতো একটা ব্যাপার, এখনকার এই ব্যস্ত সময়ে তা বুঝতে পারার কষ্টটুকু করার ধৈর্যও যেন নেই। আজকাল আমরা বাস্তবতার চাইতে বেশী অভিমানী। যুক্তির চাইতে অভিযোগকারী।

গত ক’মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬/৭ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা কিংবা ভিকারুননিসা স্কুলের অরিত্রির আত্মহত্যার খবরে বিচলিত হয়েছেন সকলেই। প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আলোচনা লেখালেখিও হয়েছে সমান তালে। আসলে এমন জীবনের অপচয় মেনে নেয়াটাই তো কষ্টকর।

পড়ালেখার প্রেশার, ঘূণে ধরা সিস্টেম, ইনফেরিওর, সুপিরিওর সব ধরনের কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষ চারপাশে, রিলেশনশিপে ব্যর্থতা, পড়ালেখার পরের ক্যারিয়ার চিন্তা, পছন্দের সাবজেক্ট এ পড়তে না পারা, অথবা প্রত্যাশিত ফলাফল না আসার মতো বিষয়গুলোতে হতাশা পেয়ে বসে। এই হতাশা থেকেই আত্মহনন।

জীবনে প্রেম দরকার তবে তা পড়ালেখা ঠিক রেখেই। ভার্সিটি লাইফও লেখাপড়ার জন্যই, বরং এসএসসি/এইচএসসি থেকে এখানে পরিশ্রম বেশি করলে সেটাই ভবিষ্যতে ভাল কিছু আনবে। ভালো রেজাল্ট জীবনে খুবই দরকার, তার মানে এই না যে, রেজাল্ট ভালো নাহলেই সব শেষ। এক/দুইটা সেমিস্টার খারাপ হলেও সঠিক দিকনির্দেশনায় ট্রাকে ফেরা অসম্ভব নয় নিশ্চয়ই। আর জীবনের যেকোনো সময় থেকেই শুরু করা যায়।

সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি? একটু সময় দিতে হবে তো। যেই মুহূর্তে ভুল বুঝে একজন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন হতে পারে ওই সময়ে ফোনের অন্য প্রান্তের মানুষটা স্যরি বলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে! একটু অপেক্ষা করা কি যায় না! যদি অপেক্ষার পরও না আসে, ধরে নিতে হবে আপনি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছেন। এই পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ না কেউ তার সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

বাস্তব জীবন তো আর স্বপ্নের মত সুন্দর না, চালার পথটাও মসৃণ না। সিনেমার মত এক নিমিষেই সব পাওয়া সম্ভব না। পারিবারিক এবং সামাজিক অপমান ঘৃণা সইতে না পেরে মরে এক অর্থে বেঁচে যায় রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী এবং ধর্মীয় অনাচারে অতিষ্ট হয়ে, সর্প দংশনে প্রাণের মানুষ স্বামীটি মারা যাওয়ার পর বিষপানে আত্মহত্যা করে শরৎচন্দ্রের বিলাসী।

একটা হতাশাগ্রস্থ মানুষের পরিবারের সমর্থন খুব জরুরি। আস্থার জায়গা হচ্ছে পরিবার। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারও ভুল করে ফেলে। আপনজনের নেতিবাচক কথা সবাই নিতে পারে না। সেই কথাগুলি তীক্ষ্ণ ফলার মতই বিদ্ধ করে ভেতরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে অসামর্থ্য হবার যন্ত্রনায় হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে মানুষ। মনে রাখতে হবে আপনজন আমাদের ভালো চান, কিন্তু তারা সবজান্তা তাদের সব ভাবনা সঠিক এমনও না। অনেক সময়ই এমন অনেক কিছু তারা বলে ফেলে যা তাদের বলা উচিত না।

হতাশা বিষন্নতা যাই বলি, গভীরতম বেদনা থেকেই মানুষ আত্মহত্যা করে। স্বচ্ছলতা, সুনাম, দুনিয়া জোড়া যশ-খ্যাতি সবকিছু থাকার পরও লিংকিন পার্ক ব্যান্ডের চেস্টার বেনিংটন আত্মহত্যা করেছিল, অস্কারজয়ী অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যা করেছিলেন। যিনি অভিনয় দিয়ে হাসি ফুটিয়েছেন দর্শকের মুখে এমনকি এন্টারটেনমেন্ট উইকলি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মজার মানুষ উপাধি দেয়। হাসিখুশি এই কৌতুক অভিনেতা বলেছিলেন “আমার মনে হতো একা একা জীবন শেষ হয়ে যাওয়া সব চেয়ে খারাপ। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। তোমার পাশে থাকা মানুষজন যখন তোমায় একা করে দেয়, তার চেয়ে খারাপ কিছু হয় না।” তিনি যখন আত্মহত্যা করছিলেন পাশের রুমেই ঘুমাচ্ছিলেন তার স্ত্রী।

মনের একাকীত্ব নিঃশেষ করে দেয় মানুষকে।
যে বাবা -মা সন্তানের শারীরিক অসুস্থায় ঔষধ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রাত জেগে সেও সন্তানের মনের অসুস্থতার খবর নেয় না। হাত ছোঁয়া দূরত্বে থাকা মানুষটাও বুঝতে চায় না কতটা নৈঃশব্দের তোলপাড় চলছে পাশের মানুষটার মনে। পরম মমতায় বুকে টেনে বলা হয় না কারোরই, এতো চিন্তার কি? আমি তো আছিই।

এমন অনেক পরিস্থিতি আসে জীবনে যখন মনে হয়, মরে গেলেই বরং বেঁচে যাই তখনই মানুষ জীবন থেকে পালাতে চায়। সব পরিস্থিতিতে সবাই সমান প্রতিক্রিয়া দেখায় না, দেখাতে পারে না। আসলে কোন সমস্যা যেমন হুট করে আসে সমাধান তেমন চট করে হয় না। যে কোন সমস্যা সমাধানের সেরা উপায় সেটার মুখোমুখী হওয়া।

হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা জে কে রাওলিং এর গল্পটা অনেকেরই জানা। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ। স্বামীর ছেড়ে যাওয়া, সন্তান নিয়ে একা থাকা, চরম দারিদ্র্যতা সব মিলে যিনি চেয়েছিলেন আত্মহত্যা করতে। সেখানে থেকে তিনি এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং সফল নারী।

হার্ভার্ডে দেয়া বক্তৃতায় নিজেই বলেন, “সাফল্য জিনিসটা অনেকটা মরীচিকার মতো। তুমি হয়তো উচ্চশিক্ষিত, তুমি মেধাবী, তার মানেই যে তুমি সফল হবে, এটা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না। ভাগ্য খুবই অদ্ভুত একটা জিনিস, কখন যে এটা তোমাকে আকাশে তুলে দেবে, আর কখন ধুম করে মাটিতে নামিয়ে আনবে, সেটা তুমি বুঝতেও পারবে না হয়তো। আমাদের সবার জীবনেই তাই কমবেশি কষ্টের গল্প আছে, হেরে যাওয়ার গল্প আছে।
তুমি যখন জীবনে প্রথম কোনকিছুতে হেরে যাবে, তখন হঠাৎই আবিস্কার করবে এ পৃথিবী ভীষণ নিষ্ঠুর একটা জায়গা। এখানে পরাজিত মানুষদের জন্যে কোন ঠাঁই নেই। সবাই বারবার তোমার দিকে আঙুল তুলে তোমাকে মনে করিয়ে দেবে যে তুমি হেরে গিয়েছো। চলার পথে অসংখ্যবার তোমাকে সুক্ষ্ণভাবে অপমান করা হবে, সেসব তোমার গায়ে শেলের মতো এসে বিঁধবে। কিন্তু এটা করা উচিত নয়। ব্যর্থতার দিনগুলোতে অপমান গায়ে মাখানোটা খুবই বাজে রকমের একটা বিলাসিতা”।

বলা হয়, মানুষ হতাশা আর বিষন্নতা থেকে আত্মহত্যা করে। আর এই হতাশা আসে না পাওয়া থেকে নয় বরং স্বপ্নহীনতা থেকে। যখন মানুষ নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয় তখনই তার মৃত্যু হয়। আত্মহত্যা তার বাস্তবায়ন মাত্র। বেঁচে থাকার জন্যে কিছু একটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা লাগে। হোক সেটা সামান্য খড়কুটো। ব্যর্থ মানুষের হারাবার তো কিছু নেই বরং কিছু করে দেখিয়ে দেবার আছে। এই জিদটা মূলমন্ত্র হিসাবে কাজ করতে পারে।

পৃথিবীর সময়টা অল্প। ভালোবেসে সহমর্মিতায় যত্নে -মায়ায় পাশে থাকি একে অন্যের। ভেতর জগতের কল্পনায় পাশাপাশি, স্বপ্নের কাছাকাছি একান্ত একাকিত্ব দূর করায় এটা কার্যকরি। যত খারাপ কিছুই আসুক নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না। স্বপ্ন থেকেই সৃষ্টি। আর এই পৃথিবীটাও তাই স্বপ্নবাজদের।

শেয়ার করুন: