‘উন্নয়ন’ এখন বিলবোর্ডে

Billboard Sahbaghসুমন্দভাষিণী: সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই চোখে ধাঁধাঁ লাগলো। পুরো শহর ছেয়ে গেছে বিলবোর্ডে। আজব ঢাকায় এ নতুন কিছু নয়। কতবার ভেবেছি, এমন আলো ঝলমলে বিলবোর্ড না জানি আবার দুর্ঘটনার কারণ হয়! এমনিতেই চালকরা বেপরোয়া, তার ওপর তাদের নজর যদি ওপর পানে তাকে, তবে বাহন যে কোথায়, কোন গন্তব্যে পৌঁছাবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে এখনকার বিলবোর্ডগুলো ভাসছে উন্নয়নের জোয়ারে। টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর মন্ত্রী-সাংসদদের নিউজ মানেই যেমন এখন উন্নয়নের তালিকা, তেমনি বিরোধী দল তথা বিরোধী নেত্রীর সমালোচনা। আবার বিরোধী দলের নিউজ মানেই সরকারের বিরোধিতা। আমি এই করেছি, সেই করেছি, উনি তা করেননি। পুরো নিউজ জুড়ে আমি-আমি আর তিনি-তিনিতে চিত্ত বিনোদিত। তাই টিভি বাদ আপাতত। কিন্তু রাস্তায় তো বেরুতে হয়, চোখ যায় নানাদিকে। সরকারের উন্নয়নের কীর্তিমাখা এসব বিলবোর্ডের কারণে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক সংস্থার বিজ্ঞাপন। আহা, সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো শোভা পেত এতোদিন, এখন সেখানে ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ সব ফিরিস্তি। ঢাকা এখন অনেকটাই অচেনা। মনে হতে পারে, পুরো ঢাকা শহর এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। পড়া মুখস্ত করার মতোন। অভিযোগ উঠেছে, কোন নিয়মই মানা হয়নি এসব বিলবোর্ড টাঙানোর ক্ষেত্রে। অনেকেই এজন্য সরকারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেছে। মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরা হয়েছে এসব বিলবোর্ডে। ‘উন্নয়নের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতা দরকার’ বলে আওয়ামী লীগকে পুনরায় নির্বাচিত করার আহ্বানও জানানো হয়েছে এগুলোতে।

এসব বিলবোর্ড বেশ হাস্যরসেরও খোরাক হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। বিরোধী দলও বরাবরের মতোই সোচ্চার। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এসব করে লাভ হবে না। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে সরকারকে জনগণের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝার আহ্বান জানিয়েছেন। গত রোববার তিনি বলেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ‘উন্নয়নের’ ফিরিস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই। সোমবার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া ও এম একে আনোয়ারও বলেন একই কথা। তারা বলছেন, গত চার বছরে দেশের কোনো উন্নয়ন আওয়ামী লীগ করতে পারেনি। অথচ এখন তারা বিলবোর্ড দিয়ে বলছে, সমস্ত দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘দলের উদ্যোগেই এই বিলবোর্ডগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভাড়া নিয়ে এগুলো বসানো হয়েছে কি না- সে বিষয়ে দলের নেতাদের কোনো বক্তব্য যেমন পাওয়া যায়নি; তেমনি বিষয়টি ‘অজানা’ বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর নেতাদেরও’। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলছেন, ঈদের আগে অনেক নতুন পণ্য বাজারে এসেছে, সেগুলোর বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন বিলবোর্ড। কিন্তু তাদের না জানিয়েই সরকারের পক্ষ থেকে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে ভীষণ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু সরকারের বিপক্ষেও তারা দাঁড়াতে পারছেন না। পড়েছেন শাঁখের করাতে। একদিকে ক্লায়েন্টদের চাপ, অন্যদিকে সরকারের ক্ষমতার হাত। ব্যবসায়ী হিসেবে কোনটাই অগ্রাহ্য করার মতো অবস্থায় তারা নেই কেউ। ফেসবুকেও এ নিয়ে ঝড় বইছে। কেউ কেউ বলছেন, এই ধরনের প্রচারণা হিতে বিপরীত হবে। যাদের উদ্দেশ্য করে এই তথ্যগুলি প্রচার করা হয়েছে তারা এরকম দাপ্তরিক ভাষা বোঝেন না। তাছাড়া এসব বিজ্ঞাপনের নকশা অতি নিচু মানের। আকর্ষণের বদলে মানুষের বিরক্তি উদ্রেক করছে। একজন লিখেছেন, প্রচারেই প্রসার, সারা শহর জুড়ে তারই নমুনা। রাজধানীর শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলোকে না হয় বিলবোর্ডের তেলেসমাতি দেখালেন সরকার বাবাজি। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোকে সমুদ্র বিজয়, আইটি বিজয় এরকম নানা বিজয় বোঝাবেন কিভাবে? বিডিনিউজ একজন বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে লিখেছে, বিলবোর্ডের অক্ষর, ছবি ও রংয়ের ব্যবহারও চরম অপেশাদারি। সমস্যা হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। খাদ্য নিরাপত্তা, কূটনৈতিক অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, যুগান্তকারী পরিবর্তন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, শিক্ষিত সমাজ, উন্নত জাতি, সবার জন্য শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা-ইত্যাদি শিরোনাম এখন শোভা পাচ্ছে বিলবোর্ডগুলোতে। উন্নয়ন মানুষ অনুভব করে তার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে, চোখ দিয়ে যতোটা না দেখে, তার চেয়েও জীবনে এর প্রভাব অবলোকন করে অন্তর্চক্ষু দিয়ে। কাজেই কতজনকে এসব বিলবোর্ড দিয়ে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বলে ভোলানো যাবে, তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয় এই বান্দার মনে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.