ডা.নাজিমুদ্দিন আহমেদ:
ভিকারুননেসা স্কুলের মেধাবী ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর মৃত্যুতে আমি একজন কন্যা সন্তানের পিতা হিসেবে শোকার্ত। গভীর মর্মবেদনা জানাই তার পরিবারকে, পিতাকে মাতাকে। তার মৃত্যু আমার কাছে কন্যা হারানোর শোক।
অরিত্রী তো নকল করার মেয়ে ছিল না। পত্রিকায় জানলাম, সে ভাল গাইতো , নাচতো, সবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত। বিনয়ী ছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছিল। অরিত্রী বেঁচে থাকলে একজন ডাক্তার হয়ে জনসেবা করতো জেনেও গৌরব বোধ করেছি একজন ডাক্তার হিসেবে।
তাহলে অরিত্রী আত্মহত্যা কেন করলো? সে কি নকল করার লজ্জায়? সে কি শিক্ষিকাদের জন্য? আমরা কি এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে চিলে কান নিয়েছে শুনে দৌড়াচ্ছি না?
তাই আমার মতো মফস্বলের একজন ডাক্তার ও সন্তানের পিতা হিসেবে অরিত্রী মৃত্যুর ১২টি কারণ খুঁজে পেয়েছি। সেসব আপনাদের জানাচ্ছি।
১. অরিত্রী মারা গেছে এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য। তাকে তো ক্লাস ওয়ানেই হত্যা করা হয়েছে , যেদিন তার কাধে ৪/৫ কেজি বই চাপাল এই সিস্টেম।
২. অরিত্রীকে কেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে ! সে কেন শিক্ষক হবে না ! শিল্পী হবে না ! কেন সে নৃত্য শিল্পী হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না? এই একমুখী শিক্ষাও তার মৃত্যুর জন্য দায়ী।
৩. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মনোবল বৃদ্ধির কোন শিক্ষা আছে কি ! একটি মেয়ে সাহসের সঙ্গে জীবনকে মোকাবেলা করতে পারলে, সেজন্য দরকারি শিক্ষা পেলে সে আত্মহত্যা করতো না।
৪. নকল নিরোধ নিয়ে বাড়াবাড়ি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। নকল করলেই তাকে টিসি দিতে হবে কেন!
শিক্ষকদের এই চেতনার জন্য দায়ী সিস্টেম।
৫. কোন আতঙ্কে অরিত্রী ওই শিক্ষিকাদের পা ধরেছিল? এই পা ধরা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলে আগামীতেও শত শত ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যার শিকার হবে। (যদিও প্রকাশিত ভিডিওতে পা ধরার কোনো দৃশ্য ছিল না!)
৬. আমাদের স্কুল কলেজে আত্মহত্যার হার কম নয়। তারপরও উচ্চ আদালতের নির্দেশ স্বত্ত্বেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ/মনোরোগ কাউন্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়নি কেন!
৭. এতো মনোবিজ্ঞানী পাশ করে বেকার বসে আছে, তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন!
৮. আমরা অভিভাবকরা শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়ে কতটা দোষমুক্ত থাকবো! আমার সন্তান স্কুল থেকে টিসি পেয়ে বাড়ি এলে তার সঙ্গে কী ব্যবহার করবো? সবাই বুকে হাত রেখে বলেন তো দেখি! কে কে বলবেন, বেশ করেছিস নকল করে, আমিও দুয়েকবার করেছি!
৯. আমার সন্তানকে শুধু ঢাকার নামকরা আত্মহত্যা স্কুলে পড়তে হবে কেন ! কেন বাবা মা হিসেবে বিকল্প ভাবতে পারবো না!
১০. জেলা থানা পর্যায়ের স্কুল কলেজ যদি মানসম্পন্ন হয় , তবে কি এই ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের কমিটির লোকজন ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিতে পারে!
১১. নকল কোন বড় সমস্যা নয়। সমস্যা হলো আমাদের মনস্তত্ব, যেখানে নকলকে একটা বিশাল সমস্যা বা অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়। এটা টিসি দেয়ার মত অপরাধ নয়। সেই মার্কিন ফেরত ট্যাক্সিচালক প্রতিমন্ত্রীকে ভুলে যায় নি , যে বেটা নকলবিরোধী এই সব ভুয়া ধাপ্পাবাজি করে মস্ত হিরো সেজেছিল।
১২. শ্রেণি শিক্ষক একা দায়ী কেন! তিনি কি আত্মহত্যার প্রশিক্ষণ দেন? সে কেন একা জেলে যাবে? তাকে জেলে নিলে আমাদের সবাইকে গণহারে জেলে নেয়া দরকার।
ডা.নাজিমুদ্দিন আহমেদ, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসক।
(লেখাটি ডাক্তার প্রতিদিন থেকে সংগৃহীত)