
তানিয়া মোর্শেদ: ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ নিয়ে এত কথা বলার কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি। সচেতনতার একটি বড় অংশ হচ্ছে, এই যোদ্ধাদের মনোজগৎ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। আজ এমন মানুষ পাওয়া কঠিন, যিনি একজনও ক্যান্সারযোদ্ধা বা কোনো যোদ্ধার আত্মীয়/বন্ধু/পরিচিত জনকে জানেন না! বাংলাদেশীদের মধ্যে এখনও অনেক মানুষ কারও ক্যান্সার শুনলেই “বিদায়” জানিয়ে দেন। অথচ বেশ কিছু যোদ্ধা বেশ কিছু বৎসর যুদ্ধ করে যান, কেউ কেউ জয়ী হোন। কে, কখন, কিভাবে চলে যাবেন তা নিশ্চিত ভাবে বলা/ জানা যায় না। একটি মানুষ যদি এক মুহূর্তও বেশী বাঁচেন তা কি সবার কাম্য নয়?
একজন ক্যান্সারযোদ্ধা হয়ে সুস্থ মানুষদের মাঝে বেঁচে থাকা/ তাদের মতই জীবন কাটানোর চেষ্টা করা মাঝে মাঝে খুব কঠিন/ কষ্টদায়ক হয়ে পরে, সুস্থ মানুষদের অজ্ঞানতা/ অনুভূতিহীনতা/ কখনো কখনো স্রেফ বোকার মত কথা বা আচরণে! ক্যান্সার মানে শুধু একটি/ একাধিক সার্জারিই শুধু নয়। আর সার্জারি মানেই অন্য সার্জারির রোগী নয়। মানে সার্জারি হলো, কিছুদিন ব্যথা/ কষ্ট থাকলো তারপর “ভালো” হয়ে গেল তা নয়। সব ক্যান্সার রোগীকেই কয়েক বৎসর করে নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় যে আবার ফিরে আসছে কি না/ অন্য কোথাও আক্রমণ করছে কি না ইত্যাদি। এই পরীক্ষাগুলো মানসিকভাবে একজন যোদ্ধাকে কি ভাবায়/ কোথায় নেয়/ কি শেখায় তা সুস্থ মানুষদের কল্পনার অতীত। আসলে “ক্যান্সার যোদ্ধা” এই লেবেল যার গায়ে লাগে, তার জীবনবোধ অন্য রকম হতে বাধ্য (কারো কারো আগেই জীবনবোধ অন্য রকম থাকে, কারো অন্য রকম যদি আগে নাও থাকে এখন হতে বাধ্য)।
অপরাধবোধ নিত্যসংগী না হলেও মাঝে মাঝে আসতে বাধ্য। বিশেষত যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান থাকে/ অসুস্থ পিতা, মাতা থাকে ইত্যাদি। যে মানুষটি নিজেই অপরাধবোধে ভুগছে তাকে এমন কথা কি বলা যায় যাতে তা আরও বেড়ে যায়? অথচ অনেকেই অসচেতনভাবেই তা করে চলেন! বেশ অনেকদিন পর একজনের সাথে কথা বললাম, তাঁর সন্তানের ভাল ফলাফলের জন্য। দু’ একটি কথার পর জিজ্ঞাসা, সার্জারির জায়গায় ব্যথা আর আছে কি না? উত্তর পাবার পর বললেন, “দেশ থেকে ঘুরে আসা “দরকার” আমার (আমাদের)।” আমার বাবা, শাশুড়ীর বয়স ও শরীরের কথা বললেন। যেন এগুলো আমার জানা/ বোঝা নেই! বুঝলাম, ক্যান্সার সম্পর্কে কোনো ধারণাই প্রায় নেই। ঠিক আছে। ধারণার কোনো দরকারও নেই। একজন মানুষের প্রতি কি আস্থা/ অনুভূতিও নেই? চেনা মানুষরাই যদি এভাবে কথা বলেন তবে অচেনাদের ভুল কোথায়!!
গতবার (প্রায় দু’ বৎসর আগে) দু’মাসের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। আমাদের কাণ্ড দেখে সবাই (এখানকার) অবাক। শীতের জায়গায় অনেক বৎসর বাস করলে গ্রীষ্মে দেশে গেলে সুস্থ মানুষদেরই অসুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। আর সেখানে ক্যান্সারযোদ্ধাদের কি অবস্থা হতে পারে! অনেকেই ভুলে যান/ জানেন না যে ক্যান্সারযোদ্ধাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম থাকে। যে কোনো জীবাণু সহজেই কাবু করে ফেলতে পারে। যা হয়ত সুস্থ মানুষকে কিছু করতে পারে না।
দীপ্তকে প্রথমবারের মত গ্রীষ্মে দেশে নিয়ে যাবার দূঃশ্চিন্তা তো ছিলই! সব সময় ডিসেম্বরে দেশে যাই। মিজানের যখন ডেঙ্গু, দীপ্ত’র প্রচণ্ড জ্বর (ভাইরাল ফিভার), আমার প্রচণ্ড কাশি। এখান থেকে এক বড় ভাই ফোনে বললেন, “তোমাকে কিছুই বলতে পারছি না।” ক’দিন আগে যখন প্রচণ্ড কাশি (কাশি হলেই চিন্তা নিউমোনিয়া হলো কি না) ডাক্তার বললেন যে, “তোমার লাংস যেহেতু কম্প্রোমাইজড, তাই তোমার কষ্ট/ ভুগবার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে অনেক বেশী।” (যা আমার জানা)। দীপ্ত স্কুল থেকে ফিরে যখন বলে, “সরি মা আমি মনে হয় জার্ম নিয়ে এসেছি!” ক্লাসে কেউ হয়ত ঠান্ডা লাগা নিয়ে এসেছে, নিজের উপর রাগ ধরে। দেখা যায়, সত্যিই আমি আবারও অসুস্থ হই। আমার কাশি মানে সুস্থ মানুষের কাশির হাজার গুণ কষ্ট! আর নিউমোনিয়া হবার সম্ভাবনাও অনেক গুণ। গতবারের সার্জারির আগে একজন বলেছিল, “এত তাড়াতাড়ি আবার সার্জারি! তাহলে গতবার (তার আগেরবারের কথা উল্লেখ করে) না করে অপেক্ষা করে একবারে করলেই হতো।” সায়েন্স পড়া, দেশের সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রী, এই দেশের ডিগ্রী, নামকরা কম্পানিতে চাকুরি, কিছুই তাকে সামান্য জ্ঞান দিতে পারেনি ক্যান্সার বিষয়ে!! আমি শুধুই বলেছিলাম, “কোন মানুষের কোথাও ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকলেই সবচেয়ে আগে চিন্তা করা হয়, কত তাড়াতাড়ি সার্জারি করা যায় (ব্লাড ক্যান্সার বাদে)।
আমার যখন রেডিয়েশন চলছিল বা মাত্র শেষ হয়েছে (পায়ের সার্জারির পর), একজন জিজ্ঞাসা করলো,” ভালো আছেন?” আমি শুধু বলেছিলাম, রেডিয়েশন চলছে/ বা মাত্র শেষ হলো। তারপরও প্রশ্ন, “ভালো আছেন তো?” অবাক হয়েছিলাম। মনে হয় অনেকেই শুধু সায়েন্স পড়ে শুধুই নিজের বিষয়ে জ্ঞান নেবার জন্য। বা ভালো নাম্বার/ পেশার জন্য। সাধারণ জ্ঞানও রাখে না/ প্রয়োজনবোধও করে না অন্য কিছু সম্পর্কে সামান্য জানবার/ চিন্তা করবার! অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “ভাল আছো/ আছেন?” আজ একটি কথা বলে যাই তাদের, জিজ্ঞাসা করুন, “কেমন আছো্?” ভালো থাকা সবার জন্যই কাম্য হলেও তা সহজলভ্য নয়! আপেক্ষিকও বটে। ক্যান্সার যোদ্ধাদের জন্য আরোই আপেক্ষিক। সে বলতে পারে, গতকাল থেকে ভালো আছি, বা গত সপ্তাহ থেকে ভালো আছি বা গতমাস থেকে ভাল আছি ইত্যাদি। জানি মানুষ চিন্তা না করেই, অভ্যেসবশত বলেন, “ভালো আছো?” কথাটা আমার কেন যেন পছন্দ হয় না, বিশেষত চেনা-জানা-কাছের মানুষ জিজ্ঞাসা করলে। আশা করি কোনো না কোনো মানুষকে বুঝাতে পারছি কী বলতে চাইছি! আর একটি কথা যে অপরাধবোধে জর্জরিত, তাকে কিছু না বলে থাকুন তাও ভালো, কিন্তু আর মনে করিয়ে দেবেন না তার ব্যর্থতার কথা!