“আমি তো এমনি এমনি #মিটু লিখছি”, এটা হতে পারে না

দিব্যেন্দু দ্বীপ:

অনেক ক্ষেত্রে এই পৃথিবীটা টিকিয়ে রেখেছে নারীরা। তবে সেই নারীরা নয়, যারা পুরুষের মতো হতে চেয়েছে এবং হয়েছে। একইসাথে পুরুষকে খারাপ বলা এবং তাদের মতো হতে চাওয়া সাংঘর্ষিকও, নয় কি? নিপীড়িত এবং বঞ্চিত নারীরা নয়, তবে শিক্ষিত এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারীদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, এবং এখনই উত্তম সময়।

অবশ্য এটা আমি বিশ্বাস করি যে বর্তমান পুরুষেরা নারীদের তুলনায় মন্দ। তবে বিশ্বাসটা পুরুষ হিসেবে নয়, বরং মনে করি ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি ক্ষমতাহীনের তুলনায় খারাপ; এটা এ কারণে যেহেতু মনুষ্যত্বের সেই চিরন্তন রূপটি এখনও সভ্যতায় অন্তর্নিহিত হয়নি।

ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও পুরুষেরা গড়পড়তায় মন্দ, কারণ, যুগ যুগ ধরে সামাজিকভাবে তারা (পুরুষেরা) যে চর্চা করে আসছে, সেটি বংশপরম্পরায় স্বাভাবিক (জন্মগত) ক্ষমতার একটি রূপ পরিগ্রহ করেছে।
খুবই কমন কথা হচ্ছে, মানুষ হতে হবে, নারীদের মানুষের একটা মডেল খুঁজে বের করতে হবে। নারীদের নয়, দায়িত্বটা আমাদের সকলের।

দিব্যেন্দু দ্বীপ:

নারীদের বলছি এ কারণে, দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারী মাত্রেই তারা পুরুষের মতো হতে চায়, আমি বুঝতে চেয়েছি, দেখেছি, এক্ষেত্রে বেশিরভাগ নারী পুরুষদের (সফল) অনুকরণ করতে চায়। অথচ এ সভ্যতায় বেশিরভাগ সফল পুরুষ এক একটা দানব।

আবার এটাও খুবই সত্য, সত্য হওয়া উচিৎ যে মনুষ্যত্বের একটি সার্বজনীন, প্রয়োজনীয়, বাস্তব একটি মডেল খুঁজে বের করার দায়িত্বটা সকলের না, বিষয়টা একাডেমিক, একাডেমিক হওয়া উচিৎ। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টা সামাজিক হয়ে রয়েছে, যেটা খুবই ভয়ঙ্কর।

মানুষ যৌনতার বিষয়ে মনোগ্যামি হবে, না পলিগ্যামি হবে, কোনটা হওয়া উচিৎ, সে ব্যাখ্যাটি বৈজ্ঞানিক হতে হবে, ধর্মীয় বা সামজিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক একটি বিষয় এখন পর্যন্ত প্রায় সব সমাজে ধর্মীয় এবং সামাজিক, এতটাই সামাজিক যে যে কেউ এ বিষয়ে মোটা দাগে বলে দিতে পারে কখন কোনটা করা উচিৎ।
মনুষ্যত্বের কিছু মডেল সমাজে নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেগুলো স্বীকৃত নয়, সম্মানিত এবং গৌরবান্বিত নয়, ফলে একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বেশিরভাগ শিক্ষিত সচেতন নারীরা তেমন হতে চাইবে না, পুরুষ তো চাইবেই না, চায়ওনি কখনও।
যৌনতার বিষয়ে, মানুষের যৌন আচরণ কেমন হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা, উপসংহার আমাদের সামনে নেই। ফলে ‘নীতি’ এবং ‘দুর্নীতি’ শব্দ দুটি এক্ষেত্রে শুধুই আরোপিত দুটি শব্দ বৈ কিছু নয়।

ক্ষমতার একটা নিজস্ব চরিত্র আছে, সেটি পুরুষ বা নারী কারও উপর আরোপিত হলেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে। এই আসল রূপটাই স্বীকৃত হবে কিনা, সেই প্রশ্নটি দিয়ে নিপীড়নের বিষয়টি মীমাংসা করার কোনো সুযোগ নেই। নিপীড়ন হচ্ছে ফৌজদারী অপরাধ, এটা মনোবৈজ্ঞানিক বা বৈজ্ঞানিক আলোচনার কোনো সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়।

ক্ষমতাপ্রাপ্ত মানুষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিক্ষিপ্ত, বিকৃত আচরণ আর সমগ্র মানুষের জন্য একটি আচরণ নির্ধারণের কথা বললে -দুটিকে একইভাবে বুঝতে গেলে ভুল হবে। একটি আক্রমণ এবং অত্যাচার; অন্যটি আবেদন, নিবেদন, অনুগ্রহ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়।

তাই মানুষকে শিখতে হবে কীভাবে একটা ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়, যেটি সব অবস্থায় প্রায় একই রকম। এবং এই শিক্ষাটা কোনোভাবেই এতো সহজ নয় যে ঢালাওভাবে বলে দেওয়া যায় এটা এভাবে ভালো, বা ওটা ওভাবে খারাপ। এক্ষেত্রেই প্রশ্নটি আসছে যে যৌনতার বিষয়ে মানুষ কেমন জীবনযাপন করবে তার জন্য একটি স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
এছাড়া শুধু যৌনতা দিয়ে মানুষকে পরিমাপ করতে চাওয়াটাও খুব ন্যায্য নয়, যদিও এটা অনেক কিছুর নিয়ামক অবশ্যই। একসময় নারীর বহুগামিতাকে প্রয়োজনীয় ভাবা হতো, কালক্রমে সেটি পরিবর্তন হলো, আবার যে উল্টোপাল্টা হবে না, তাও তো বলা যায় না।

তাছাড়া নারীর প্রয়োজন নারী নির্ধারণ করবে, পুরুষের প্রয়োজন পুরুষ নির্ধারণ করবে, প্রতিটি ব্যক্তি নির্ধারণ করবে, এবং সেই নির্ধারণ করার বিষয়ে আজ্ঞা আসতে হবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে, ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়।
তাই নিপীড়নের কথা বলতে গিয়ে নীতিকথা বলা ঠিক না। অভিযোগ করতে গিয়ে দার্শনিক আলোচনা করা ঠিক না, দুটো বিষয় এক না।

এটা মানতে হবে যে সমাজে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে, এবং খুব বাজেভাবে ঘটছে। এসবের প্রতিকার হওয়া দরকার, অভিযোগ হিসেবে আসা দরকার, শুধু বিখ্যাত কারও বিরুদ্ধে টুকটাক একটা অভিযোগ নয়, অভিযোগ হওয়া দরকার যেকোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে, এবং অবশ্যই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আইনানুগভাবে, সেই সুযোগটি সৃষ্টি করার জন্য সকলের কাজ করা দরকার।

তবে সামাজিক এসব অভিযোগেরও গুরুত্ব আছে, তবে সেই গুরুত্ব তখনই লোপ পায় যখন অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে শুরু করে সাধারণের সমস্যা পাশ কাটিয়ে এবং সাধারণ জনগণকে ফাঁসিয়ে। এতে দিনশেষে অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী দুজনেই আবার লাভবান হতে শুরু করে। ঝুঁকি থাকে, অভিযুক্ত ব্যক্তিই বেশি লাভবান হয়ে যাবে। এভাবে এরকম একটি সর্বময় সমস্যাও শ্রেণিচরিত্র লাভ করতে শুরু করে, যেটি অবশ্যই খুব ভয়ঙ্কর, এবং এখন হচ্ছে তাই।
সবচে’ বড় কথা হচ্ছে, খুব জটিল একটা বিষয়কে যেভাবে খুব সরলভাবে আলোচনা করা হয়, এবং এমন সব মানুষ এটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছে, ফলে এতে কিছু বিপর্যয় ছাড়া লাভ কিছু হবে না, হচ্ছে না।

ব্যক্তির অভিযোগ শুধুই একটা অভিযোগ, এবং অবশ্যই সেটি অভিযোগ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিৎ। “আমি তো এমনি এমনি #মিটু লিখছি”, এটা হতে পারে না। অবশ্যই এটি অভিযোগ। তবে এসব অভিযোগ দিয়ে তাত্ত্বিক একটি মডেল দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই।

#MeTooBangladesh

লেখক, সাংবাদিক

শেয়ার করুন: