উইমেন চ্যাপ্টার:
জামিন পেয়ে গেল বহুল আলোচিত বনানী রেইনট্রি হোটেলে সংঘটিত সেই ধর্ষণ মামলার মূল হোতা সাফাত আহমেদ, যে কিনা
আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে। সাফাতের নেতৃত্বে পুরো একটা গ্যাং সেদিন ধর্ষণকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল। অথচ কী অবলীলায় একে একে সব ছাড়া পেয়ে গেল, সাফাতের যে ড্রাইভার সেদিন পুরো ঘটনাটার ভিডিও করেছিল সাফাতের নির্দেশে, সে আগেই ছাড়া পেয়েছে। ঠিক কতো টাকায় এই হিসাব মেটানো হলো, জানতে চায় মন।
সম্পদশালী অসৎ এবং ভণ্ড বাবা সেদিন তার পিশাচ ছেলের এই কাণ্ডকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিল, “আমিও তো অনেক জায়গায় আকাম করি। করুম না কেন। আমি কি বুড়া হইয়া গেছি নাকি? আমার যৌবন নাই? আমিও তো হোটেলে যাই। আমার ছেলে যদি হোটেলে ওগো লগে কিছু কইরা থাকে তো মিলমিশ কইরা করছে। ধর্ষণ করতে যাইব ক্যান?”
নিজের ছেলের ‘চারিত্রিক সনদ’ এভাবেই দিয়েছিল তার ততোধিক ‘চরিত্রবান’ পিতা।
বাংলাদেশে আজতক কোনো ধর্ষকের কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এখানে ধর্ষকরা স্বগর্বে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু ধর্ষণের শিকার মেয়েদের সমাজের লোকচক্ষুর ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে যে ঘটনাগুলো প্রচার হয়ে যায়, আলোচনায় আসে সেগুলোর পরিণতিও কি খুব একটা সুখকর? এসব ঘটনায় বিচার চাইতে গেলে সমাজের আঙ্গুল ধর্ষকের দিকে উঠার আগে মেয়েটির দিকেই যায়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র কেউই পিছপা হয় না এই ভিক্টিং ব্লেমিং থেকে। সর্বশেষ মিটু আন্দোলনে মুখ খুলেছে যেসব মেয়ে, তাদের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেও একইরকম চিত্র পাওয়া যায়।
গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ছিল বনানীর রেইন্ট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনাটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে জন্মদিনের পার্টিতে নিয়ে রাতভর চলে ধর্ষণলীলা। জন্মদিনের পার্টিতে একশ জন থাকবে বলে তাদের আনা হয়। কিন্তু দেখা যায় সেখানে আর কেউ নেই। শুধু তারা তিনজন নারী, একজন ছেলে আর ধর্ষকদের দল৷ এই ঘটনাটি যখন প্রকাশ্য হয় তখন আলোচনার তুঙ্গে উঠে যায় তখন দেখা যায় ধর্ষকের দলের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ।
সাফাত তার বাপের ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে সেদিন অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিল, যা আমরা ভুলিনি। সে বলেছিল, “আমার বাপ কি বাল ফালায়? সোনা বেচে… সোনা। এই দেশের এয়ারপোর্টের সব সোনা কই যায়? কই ত্থেইকা আসে? সব আমার বাপের আন্ডারে। তোগো মতো এমন দুই একটারে কাইটা ভাসায়া দিলে কেউ টের পাইবো না।” এমন একটা ভয়াবহ দুর্নীতির ক্লু খোদ ছেলের মুখ থেকে আসার পরও সরকারি যন্ত্র নড়েচড়ে বসেনি, কাউকে এই দুর্নীতি বা চোরাই কারবারের জন্য গ্রেপ্তার দূরে থাক, কোনরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও খবর আসেনি।
ধর্ষক সাফাতের পিতা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম যে ধোয়া তুলসী পাতা নয়, সে তো সবাই জানে। পত্রিকায় প্রকাশ্যেই তার ছেলের কুকীর্তিতে বৈধতা দিয়েছিল এই বলে যে, “আরে ভাই এমন ফালতু বিষয় নিয়ে হৈচৈ করার কি আছে? মানছি আমার ছেলে আকাম করছে। কিন্তু ওই দুইটা মেয়েও তো ভালো না। খারাপ মেয়ে। তা না হলে কেউ গভীর রাতে হোটেলে যায়? ভদ্রঘরের কোনো মেয়ে কি রাত-বিরাতে হোটেলে যাবে?” দেশের সবগুলো মিডিয়া চ্যানেল, যারা নারী নির্যাতনের ঘটনায় সবসময় সোচ্চার থাকে, তারাও আপন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপণ প্রচার বন্ধ করেনি। কে জানে, ভিতরে ভিতরে বিজ্ঞাপণের রেইট বাড়িয়ে মুখগুলো বন্ধ করা হয়েছিল কীনা!
এই যে ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে গেল, এখন অভিযোগকারী মেয়ে দুটিকে নিরাপত্তা কে দিবে? সাফাত জামিনে বেরিয়ে এসে ধর্ষিতাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে কিনা, এই মামলাকে প্রভাবিত করে কিনা সেই ভয়ই হচ্ছে। ধর্ষণের মামলাগুলোতে এরকম বিগফিশদের প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনা মেয়েগুলোর জন্য আদৌ সুখকর নয়।