#মিটু: বেদনার আখ্যানকে নাকচ করে দেবেন না

সালমা লুনা:

হে বাঙালি জনগণ!
কোন এক হেমন্ত সকালের সোনাঝরা রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলাতে বুলাতে যদি দেখতে পান আপনার অতি নিকটাত্মীয়, নমস্য গুরুজন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বন্ধু সাংবাদিক, সমীহ করার মতো প্রতিবেশী, প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব, মান্যবর কোন তালেবরের বিরুদ্ধে মিটু বলে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন কেউ, তবে চট করেই সেই অভিযোগকারীকে চরিত্রহীন আর মিটু নামক তার বেদনার আখ্যানটিকে কোন অর্থহীন শব্দাবলী প্রয়োগে নাকচ করে দেবেন না।

ঈশ্বরতুল্য মানুষ ভেবে সমীহ করেছেন একদা অথবা ঋষিজ্ঞানে সবসময় যাদের সম্মুখে মাথা ঝুঁকিয়েছেন তাদের এই একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ হয়তো আপনি পাননি। তাই বলে তাদের কৃত পাপের দায় আপনি কেন মাথায় নেবেন অভিযোগকারীকেই হেনস্থা করে !

আবার ইলেকশনে নমিনেশন পেয়েছে বলেই অপজিশনের সহযোগিতায় কারো বিরুদ্ধে মিটু এসেছে এই অভিযোগটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তারও নিশ্চয়ই তদন্ত হবে কিন্তু ইলেকশনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি অতীতে বা বর্তমানে কোন নারীকে যৌন নিপীড়ন করেছেন অথবা করেন, সেই তাকেই আরো ক্ষমতা দিতে আপনারই কি মন চাইছে?
সমাজে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিটি আরো ক্ষমতা পেয়ে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা তো সহজেই অনুমান করতে পারেন আপনি।

সালমা লুনা

আমরা তো জানি এসবের পেছনের সত্যিটাকে।
এসব নিপীড়কের সাহসের অন্যতম কারণ তাদের সামাজিক ক্ষমতার কারণে নিপীড়িতর মুখ খুলতে ভীতি। আর এই ক্ষমতা এসেছে নিপীড়কের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আর সীমাহীন অবৈধ সম্পদ থেকে।

কাজেই ফেসবুকে রগড় করার আগে কিংবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুখ টিপে ‘আগে কেন বলেনি?’ ‘এতদিন কেন চুপ ছিলো?’ এইসব অবুঝ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবার আগে নিজের কন্যা বোন স্ত্রী বান্ধবী শ্রেণীর কোন নারীর সাথে আলোচনা করুন। এমন কোন দুঃখজনক অপমানের কাহিনী তার জীবনেও আছে কীনা জানতে চেষ্টা করুন ! সেই দুঃখ আর অপমানটুকু তারা কালো কুচকুচে কৌটোয় পুরে বুকের তালদিঘীতে খুব গোপনে ডুবিয়ে রেখেছে কীনা জানুন। অথবা ভাবুন অভিযোগকারীর জায়গায় আপনি বা আপনার প্রিয় কোন নারী হলে কী হতো?
ঘটনার সময়ে হয়তো এই নষ্ট সমাজের ভয়ে আপনিও এমন চুপই থাকতেন।

এভাবে চুপ থেকেই একটা সমাজ অনেকদিন ধরে পঁচেছে। আর ভয়াবহ সব যৌন নিপীড়নের ঘটনা খুব গোপনে ঘটে গেছে দিনের পর দিন। অনেকসময় জেনেও ‘চুপ’ ‘চুপ’ বলে উঠেছি আমরাই। ঠুনকো মানের ভয়ে সয়ে গেছি অথবা সইতে বাধ্য করেছি কত নারীকে। ফলে এই নিপীড়ন দিনে দিনে আরো বেড়েছে, আর বেড়েছে নিপীড়কের সাহস। আমাদেরই অজ্ঞতায় একটুখানি সাহসের অভাবে নিপীড়কের দিকে যথাসময়ে আঙ্গুলটি তুলতে না পারাই পচিয়েছে আমাদের সমাজকে।
এখন যদি পচাগলা সমাজের চিকিৎসা করানোর দরকার হয়, এই প্রজন্মের কেউ যদি তার হাল ফেরাতে চায়- মিটু র সাথে একাত্ম হয়ে। তাতে আপনার অকারণ অমত থাকাটা অযৌক্তিক। আপনার এই মানতে না পারা সন্দেহই বাড়াবে শুধু।

আপনি যদি নিপীড়িতকে সন্দেহ করেন তবে আপনাকেই সন্দেহ নয় কেন? হতে পারে আপনিও কিছু লুকোচ্ছেন কিংবা সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছেন। সহযোগীর ভূমিকা তো আপনি নিতেই পারেন, কেননা নিপীড়করা কখনো একলাও ছিলো না। সবসময়ই কেউ না কেউ তাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা করেছে। আপনি একা হয়ে অথবা পুরো সমাজকে সাথে নিয়ে এই সহযোগিতা করেছেন।
তখনও! এখনও।

আপনি চিন্তিত নিপীড়কের সামাজিক মানসম্মান নিয়ে। এভাবে এতোদিন পরে কী দরকার ছিলো মুখ খোলার!

কিন্তু দেখতে কি ভালো লাগবে, আপনার অথবা আপনারই কোন প্রিয়জনের নিপীড়নকারী অসীম ক্ষমতাধর হয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনায়াসে? এবং ভবিষ্যতে গোপনে আরো নিপীড়নের লাইসেন্সটি দিচ্ছেন আপনিই।

মিটু কে নিপীড়ক ছাড়া কেউ ভয় পাবার কথা না। কারণ, মিটু হচ্ছে একটা সাহস। যে সাহস তখন ছিলো না বলে নিপীড়িতরা মুখ খোলেননি।
মিটু হচ্ছে সেই সাহস, যা এতোদিন পরে সেই তালদিঘীর গভীর জলের ভেতর থেকে কালো কুচকুচে কৌটার ভেতর থেকে বেদনাকে তুলে এনে উড়িয়ে দেবার শক্তি যুগিয়েছে। মিটু হচ্ছে সেই সাহসী ধাক্কার নাম, যা আপনার অন্ধ বিশ্বাসের ঝুরঝুরে প্রাসাদ ধরে নাড়া দিয়েছে।
মিটু- ই সেই সাহসী হাত, যে হাত সমাজের অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত নিপীড়কের মুখোশ খুলে দেবে এবং হবু নিপীড়কের আপনার নিজের কন্যা কিংবা তার কন্যার দিকে বাড়ানো হাতটি ভেঙে দেবে।

তাই মিটু কে সন্দেহ নয়, অভিযোগকারীকেও নয়। সন্দেহ যদি করতেই হয় নিজেকে করুন, যৌন নিপীড়নহীন একটি সমাজ কী আদৌ আপনি চান! তবে আপনি কেন চাননা মিটু রব বাংলাদেশে জোরেশোরে উঠুক?
নাকি চাইছেন মিটু’র আঙ্গুল উঠবে শুধু আপনার প্রিয়দের বাঁচিয়ে?
এ তো আর সম্ভব নয়, তাই না?

যিনি মুখ খুলতে চাইছেন তাকে মুখ খুলতে দিন।
সত্য আর মিথ্যা সময়ই যাচাই করুক।

#মিটু

#solidarity_with_Me_too

#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন: