আমি এবং #MeToo

তামান্না ইসলাম:

সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে #MeToo আন্দোলনের জোয়ার এসেছে। একেকটা ঘটনা পড়ি আর আঁতকে উঠি। আমি আবার যাই পড়ি, মোটামুটি সব চরিত্রেই নিজেকে কল্পনা করে ফেলতে পারি। তাই এই লেখাগুলো পড়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শরীর কুঁকড়ে উঠে ভয়ে, সর্বাঙ্গ এক বমি বমি অনুভূতিতে তীব্র ঘৃণায় গুলিয়ে উঠে।

প্রিয়তি এবং সীমন্তির প্রতিবাদের পর থেকে নিজের ভেতরে প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করি। অল্প বয়সে তসলিমা নাসরিন পড়ে কেন যেন সেই অনুভূতি হয়নি। অন্য অনেকের মতোই তখন সুক্ষ্ম রুচিবোধে আঘাত হেনেছে, সন্দেহ হয়েছে, সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে এমনও লেখে কেউ?

আসলে আমার জগত তখনও রূপকথার রাজকন্যার মতোই অতি সুরক্ষিত এক জগত। আমার মনে তখনও পৃথিবী অনেক পবিত্র, সুন্দর। এরকম কদর্য পৃথিবীর সাথে আমি তখনো পরিচিত হইনি। আমার কল্পনার বাইরে, কোন মেয়ের নিজের পরিবারে, চেনা জানা গণ্ডিতে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এমন কেবল সিনেমাতে হয়, একমাত্র গুণ্ডারাই এমন করে। তবে সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মাঝে পড়ি, কিন্তু সেগুলো ধর্ষণের বা অপহরণের ঘটনা, সেগুলোও গুণ্ডা, মাস্তানরাই ঘটায়।

আমার পরিচিত কাছাকাছি বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হলো, রাস্তায় স্কুলে যাওয়া আসার পথে বা বাসার সামনে পাড়ার ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে থাকা, যেটাকে আমি ভয় পেতাম ভীষণ। বাসায় ফোন আসা অথবা চলার পথে দু’ একটা উড়ো মন্তব্য। এগুলো অবশ্যই বিরক্তিকর, আমি আসলে ভয়ও পেতাম। কিন্তু আমার মাথায় কেউ ঢুকায়নি যে এগুলো আসলে এক ধরনের যৌন নির্যাতন। আমি কুকুরকেও ভীষণ ভয় পেতাম এক সময়। সেসময়ে নিজেই একটা বুদ্ধি বের করলাম, কুকুরের চোখের দিকে তাকাবো না, তাহলে ওরা আর ঘেউ ঘেউ করবে না। কেউ শিখায়নি। নিজে নিজে চিন্তা করে বের করেছি। এই একই পদ্ধতি আমি ব্যবহার করতাম ওই সব ছেলের সাথেও। কোনদিন চোখ তুলে তাকাইনি। তাই বলতে পারবো না তাদের দৃষ্টি কেমন ছিল।

সেই আমি অবশ্যই বয়সের সাথে সাথে পাল্টেছি। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হয়েছে অনেক কিছু। একটি মেয়ের মা হয়েছি। নিজের জন্য যতটা না ছিলাম, মেয়ের জন্য আমাকে আরও অনেক কিছুই জানতে হচ্ছে। এখন #MeToo এর অভিজ্ঞতাগুলো পড়লে, ভাবি আমি কত বোকা ছিলাম। এধরনের অভিজ্ঞতার কথা মানুষের সামনে বলতে কতখানি সাহস লাগে। যে এসবের মধ্যে দিয়ে গেছে সেই শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী কতখানি কষ্টের মধ্যে ভেঙ্গেচুড়ে গেছে, কী মানসিক আতঙ্ক সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা অনেকেই হয়তো সেটা বুঝবো না পুরোপুরি।
আমার অস্থিরতা ছিল ওদের জন্য। ওদের জন্য কী করতে পারি। লেখায়ই আমার একমাত্র পথ। আমার নিজের সরাসরি কোন অভিজ্ঞতা নেই বলে, আমি লিখলে পুরোপুরি কষ্টের অনুভূতিটা প্রকাশ পাবে না।

অনেক ভাবলাম, আমাকে কিভাবে বড় করা হয়েছিল, যে আমাকে এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্পর্শ করেনি। আমি দুটো উত্তর খুঁজে পেয়েছি।

এক, আমার বাবা, মা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন সন্তানদের ব্যাপারে। আমি স্কুলে কখনো একা যাইনি। পায়ে হেঁটে যেতাম, কিন্তু সঙ্গে বাবা থাকতেন। বা বান্ধবীরা দল বেঁধে। সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না। দূরে কোথাও যেতে হলেও বাবা, মা, ভাই, অন্য বান্ধবীদের সঙ্গে যেতাম। অর্থাৎ, একা বাইরে যাওয়া হতোই না প্রায়। আমি বাসে চড়েছি হাতে গোনা কয়েকবার, তাও দূর পাল্লার বাসে, ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে হলে। টেম্পো বা এজাতীয় কোনো যানবাহনে উঠিই নাই। রিকশা বা ট্যাক্সি ছিল যাতায়াতের একমাত্র উপায়। বাজারে, মার্কেটে যেতাম খুব কম। মা বা বাবার সাথে। অর্থাৎ পাবলিক প্লেসে যেসব ক্ষেত্রে হ্যারাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেসব জায়াগায় যাওয়ায়ই হতো খুব কম।

খালি বাসায় কখনো কেউ আসতো বলে মনে পড়ে না। বা, আমি যেন সেরকম পরিস্থিতিতে না পড়ি সেদিকেও খুব খেয়াল রাখতেন বাবা, মা। অর্থাৎ, আমি সার্বিকভাবেই খুব সুরক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছি। তারপরেও বলবো, ভাগ্য সহায়ক ছিল। কারণ, মা চাকরি করতেন। বাসায় সহকারীদের সাথেও তো থেকেছি কত। তারাও তো কিছু করতে পারতো। আপন চাচা, মামা, খালু এদের সাথে এক রিকশায় উঠেছি, পাশাপাশি বসেছি, ছোটবেলায় নিশ্চয়ই কোলেও উঠেছি। স্কুল, কলেজে স্যারদের বাসায় পড়তে গিয়ে কখনো কখনো প্রথমে গিয়েছি, দুর্ঘটনা ঘটলে ঘটতেই পারতো।

আসলে সার্বিকভাবে সার্বক্ষণিকভাবে একটা মেয়েকে রক্ষা করা কারো পক্ষেই সম্ভব না, এটা কোন সমাধানও না। আমাকে যেভাবে বড় করা হয়েছে, তাতে আমার এধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নেই ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে আমি একজন প্রচণ্ড ভিতু মানুষ হয়ে গেছি। এটাও একধরনের পঙ্গুত্ব।
আমার এখনো সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকতে ভয় লাগে। তাছাড়া অনেক চেষ্টা করেও, সবার ভাগ্য সদয় হবে, সেটা নাও হতে পারে। সব পরিবারের অবস্থাও এক নয়। জীবনের প্রয়োজনেই অনেক মেয়েকে একা চলাফেরা করতে হয়, হবে, একা থাকতে হয়, অনেক মানুষের সাথে একা থাকার মত পরস্থিতিও হয়, বাসে, টেম্পোতে উঠতে হবে। সচেতনতা বাড়িয়ে, মা, বাবা এবং বাচ্চাদের মাঝে এগুলো কিছুটা কমান যাবে, বন্ধ করা যাবে না পুরোপুরি কখনোই। তাছাড়া, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে মানসিকভাবে আতঙ্কিত, ভীত, দুর্বল করেও গড়ে তুলতে চাই না।

দ্বিতীয় যে কারণে, আমি ভেবেছি আমার এই অভিজ্ঞতা নেই, সেটা হলো, বাংলাদেশে বড় হতে হতে আমি নোংরা দৃষ্টি, আচরণ, কথা বা স্পর্শে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মানিয়ে নিতে শিখে গেছি এবং সর্বোপরি লুকাতে জানি। গাওছিয়া মার্কেটের ভিড়ে গায়ে হাত পড়েনি, এমন অভিজ্ঞতা খুব কম মেয়েরই আছে। বাসায় এসে মা, বাবাকে বলে কয়টা মেয়ে? উত্তর হবে ‘মার্কেটে যাওয়ার দরকার কী? আর কি মার্কেট নাই?’ এই ঘিনঘিনে অভিজ্ঞতা অন্য মেয়ের মতো আমারও আছে। কাকে বলবো? মা, বাবা, স্বামী সবাই একই উত্তর দেবে। অনেকে আরও বাজেভাবে বলবে ‘এই সব খোঁচা খেতেই মেয়েরা এইসব মার্কেটে যায়।’

বান্ধবীর বাড়ন্ত গড়নের কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফাঁকা দোকানেও দেখেছি মা, খালাকে উপেক্ষা করে কেমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আমাদের মায়েদের সাথে পার্থক্য হলো, তারা হয়তো আমাদেরকেই উল্টো বকা দিতেন ‘এসব কাপড় পরে বেরিয়েছো কেন?’ আমরা মেয়েটাকে সেই বকাটা দিলাম না, কিন্তু মেয়ের মনের মধ্যে লেগে যাওয়া খারাপ অনুভূতির কাদাটা কিন্তু ঠিকই লেগে গেল।

ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার আগেই মায়ের কাছে শুনেছি ঢাকা ইউনিভার্সিটির কিছু কিছু শিক্ষকের কথা, যারা একা বাসায় ছাত্রীদের কাজের অজুহাতে ডেকে নিয়ে আসে। আমার মা সাহসী মহিলা, প্রয়োজনে জুতার বাড়িও দিতে পারে। আমি তা না। যদিও বুয়েটে এমন কিছু শুনি নাই। তবুও সাবধানের মার নাই। একা একা শিক্ষকদের রুমে যেতাম না, একান্ত বাধ্য হলে বন্ধুরা কেউ দাঁড়িয়ে থাকতো রুমের বাইরে।

আমার অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু বান্ধবীদের কাছে শুনেছি, চাকরি দেওয়ার অজুহাতে বসদের দরজা বন্ধ করার চেষ্টা।
আচ্ছা খালি মেয়েদের কথা বললাম। ছেলেদের কথা না বললে অন্যায় হয়ে যাবে।

বয়স্ক নানী দাদি শ্রেণির মহিলাদের কখনো দেখেছেন বাচ্চা ছেলেদের পুরুষাঙ্গ ধরে বা সেটা নিয়ে রসিকতা করতে? অশ্লীল এক দৃশ্য, ভাবুন তো শিশুটির কেমন বিকৃত অভিজ্ঞতা হয়!
এক কিশোরের গল্প শুনেছিলাম, তার খালার স্বামী অসুস্থ। সেই খালা ভাগ্নেকে জোর করে নিজের শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছে।

আরেক সদ্য যুবক, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফাঁদে ফেলেছে ছাত্রের মা।
এই কিশোর, এই যুবকের মনে যে ভয় ঢুকে যায়, তা থেকে বের হয়ে আসতে তাদের অনেক সময় লাগে।

এগুলো সবকিছুই আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। এই সব সাবধানতা আমাদের প্রতিদিনের ভাত খাওয়ার মতোই নিজের প্রতি নিজের একটা দায়িত্ব। এইসব দৃষ্টি, কথা, স্পর্শ, আচরণ এগুলো আমরা হজম করে ফেলতাম খুব স্বাভাবিকভাবে, তাই আমার ছিল না কোন #MeToo অভিজ্ঞতা।

কিন্তু, আমি এখন জানি এগুলো কত বড় অন্যায়। ধন্যবাদ এই আন্দোলনকে, যা আমাদের মত অনেক মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। ধন্যবাদ প্রিয়তি, সীমন্তিকে পথ দেখানোর জন্য। অন্যদেরকেও, যারা আমাদেরকে কথা বলার সাহস জুগিয়েছে।

#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.