সাবরিনা স সেঁজুতি:
আমি-আপনি কেউ-ই খ্যাতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা নোংরা চেহারা দেখতে চাই না। আমাদের ভালো লাগে না। এই ভালো না লাগাটা অপরাধের কিছু নয়।
খ্যাতিমান মানুষগুলো হবে ফেরেশতা, এমনটা কল্পনা করাই সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটা স্বপ্নপুরি নয়। এটা আমার-আপনার বাস্তব জগত। আর সে কারণেই নানাবিধ আইন, জটিল বিচার প্রক্রিয়া দিয়েও বিশ্বে যৌন নিপীড়নের মত নিম্নরুচির অপরাধগুলো পুরোপুরি নির্মল করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে আমার অবাক লাগে যখন দেখি, অভিযুক্ত পুরুষটিকে নিষ্পাপ, দুধে ধোওয়া তুলশি প্রমাণ করতে যত সংখ্যক নারী-পুরুষ তার পাশে দাঁড়ায়, তার সিকিভাগ নারী-পুরুষও ভুক্তভোগীর পাশে থাকে না।
পুরুষেরা কেন অভিযুক্ত পুরুষটির পাশে এসে দাঁড়ায় তার ব্যখ্যা জটিল কিছু নয়। “চোরে চোরে মাসতুতো ভাই”- এটা বাংলার অনেক পুরোনো প্রবাদ। ক্ষমতাধর খ্যাতিবান চোরের চরিত্র জনসম্মুখে এভাবে ব্যবচ্ছেদ হোক সেটা ছোট-বড় কোন চোরেরই কাম্য নয়। রাঘব বোয়ালেরা যদি জলে পড়ে হাঁসফাস করে তখন চুনোপুটিদের কলিজা শুকিয়ে যায়। সেই আতংকে চুনোপুটির দল প্রথমেই অভিযোগকারীর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তারপর অপরাধের প্রমাণ খুঁজে, তারপর দেশের শক্ত আইনের দোহাই দিয়ে যাবতীয় ত্যানা প্যাচানীমূলক তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে ‘মিটু’ অন্দোলনের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।
এদিকে উন্নত, অর্ধ উন্নত, অনুন্নত- সকল দেশের আইন-ই যে কত নারী বান্ধব তা প্রমাণ করতে আরেক দল পোনামাছের ঝাঁক জলে ছটফট করতে থাকে। কেউ কেউ নিজের জীবনের বাস্তবমুখী উদাহরণ দিয়ে, ভালো নারী-খারাপ নারীর সংজ্ঞায়ন করে, আইনের আশ্রয় নিয়ে বিপদ থেকে মুক্তি পাবার উপায় বাঁতলে দেয়, এমনকি প্রমাণ খুঁজে আনতে পারলে সে নিজেই অপরাধীকে শাস্তি দেবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ফলাফল, ধীরে ধীরে জনগনের দৃষ্টি মূল ঘটনা থেকে সরে পড়ে অনেক দূরে।
মাসতুতো ভাইদের এইসকল কর্মকাণ্ড দেখে আমি পুলকিত না হয়ে পারি না। একে অন্যের প্রতি তাদের যে গভীর ভালোবাসা তা দেখে ভিতরে ভিতরে আমি আরো সাহসী হয়ে উঠি। আশার আলো খুঁজে পাই। উপলব্ধি করি, আমাদের সমাজে মাসতুতো ভাইদের কদর এখনো আছে। তাদের সম্পর্ক এখনো অটুট। যদিওবা একটু চোখ নাক মুখ খোলা রাখলে জানা যায়, সামান্য একটি নারকেল গাছ বা পুকুরের মাছ ইত্যাদি খুচরা বিষয়-আসয় নিয়ে আজো শুধু মাসতুতো ভাই নয়,মায়ের পেটের আপন ভাইয়ের মধ্যেও খুনোখুনি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখনই নারী ঘটিত ঘটনা প্রকাশ পাবে, তখন একদল মাসতুতো ভাই চোখে টিনের চশমা পরে মুখে ছিপি দেবে।
আরেক দল, “আমার ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র” স্লোগান দিতে দিতে মিছিলে নামবে। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মিছিলে নামার ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। কষ্ট করে সশরীরে রাস্তায় না নেমে, অভিযুক্তের পক্ষে বড় বড় পোস্ট প্রকাশ করলেই বেশ ‘সহমত ভাই’সুলভ কাজ হয়ে যায়।
‘মিটু’ আন্দোলনে ভাইদের এই বিশেষ ভূমিকা-ই আমাদের কাম্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মাস্তুতো ভাইয়েদের এই মাখামাখিতে আমাদের আপামনিরা কেমন করে ঢুকে পড়েন? তারাও রাস্তায় নেমে…… দুঃখিত, সোশ্যাল মিডিয়াতে অভিযুক্তের পক্ষে বড় বড় পোস্ট দিয়ে আসলে কি প্রমাণ করতে চান? সেই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে পরিস্কার নয় ।
তাই আলোচনা হচ্ছিলো আমার জনৈক এক বন্ধুর সাথে। এই বিষয়ে আমার জনৈক বন্ধুর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা আছে । আশা করছি, বন্ধুটি কারও সম্পর্কে মাসতুতো ভাই নন।
যাই হোক, সেই জনৈক বন্ধুর ব্যাখ্যা মতে, পুরো খেলাটা আসলে খেলছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধ বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’।
তোমার স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্ত?
হু!
তোমার স্বামীর নয়, তোমার সমস্যা।
কিভাবে?
তুমি রূপে, গুণে, মোহে তাকে বাঁধতে ব্যর্থ হয়েছ।
তোমার ছেলে মেয়ে-ঘেষা?
হু!
হবেই তো, মা হিসেবে তুমি তো তাকে ভালো কিছু শেখাওনি।
আপনার সহকর্মীর আলুর দোষ আছে?
হু! অভিযোগ উঠেছে।
আপনি টের পাননি?
না।
হে হে! আপনি তবে স্বেচ্ছায় সহকর্মীর সাথে…?!
অন্যদিকে যে নারীর প্রতি পুরুষের কুনজর পড়েছে সেই নারীকে সমাজ বোঝায়-
ভদ্রলোক তোমার দিকে কুনজর দিয়েছেন?
হু!
নিশ্চয়ই তুমি আকারে-ইঙ্গিতে তাকে কাছে ডেকেছো। তা না হলে এরূপ দেবতুল্য পুরুষমানুষ কোন দুঃখে তোমাকে ছোঁবে?
সব কথার শেষ কথা, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। পুরুষের পাপের দায়ভার নিজের অজান্তেই নারীর উপর চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। তাই পুরুষের অপকর্ম নারী সজ্ঞানে গোপন করাই শ্রেয় মনে করেছে। বর্তমান যুগেও, একজন নারী যদি একজন যৌন নির্যাতকের পাশে দাঁড়ায়, তখন সে পুরুষকে ভালোবেসে নয়, অনেকসময় অন্য একজন নারীর কথা বিবেচনা করেও পুরুষের পাপ গোপনের চেষ্টা করে।
আমার বন্ধুর এই ব্যখ্যায় আমি আংশিক সন্তুষ্ট হলাম। তবে আমার মনে হয়, শুধু নারীত্বের অবমাননা হবে সেই ভয়ে নয়, তাদের মনে আরো অনেক ভয়।
সমাজের সুপরিচিত ভাল মানুষগুলো রাতারাতি সমাজের চোখে খারাপ হয়ে গেলে, আজকে যে পুরুষটির সাথে আমি-আপনি ঘরে-বাইরে কাজ করছি, বাস করছি, তারাও সমাজের আতশ কাঁচের নিচে চলে আসবে। আমাদের ছেলে, ভাই, বাবা, চাচা, মামা, ফুপা, খালু, দাদা, নানা কাউকেই আর চট করে বিশ্বাস করা যাবে না। একটা কেঁচো খুড়তে যেয়ে হাজারটা কেঁচো বেরিয়ে পড়বে। প্রকাশ পেয়ে যাবে সমাজের কুৎসিত রূপ। এইসব নানাবিধ ভয়।
তাই ভয়ে কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে আছে। কেউ কেউ অপরাধীর পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু বাঘের ভয়ে হরিণের মতো চোখ বুজে দিন যাপন করবেন আর কতদিন?
‘মিটু’ অন্দোলনের শাখা-প্রশাখা যত ছড়াবে, সমাজের কোণা-ঘুপচি থেকে বেড়িয়ে আসবে লুকিয়ে থাকা আবর্জনা । বেরুবে দুর্গন্ধ। কিন্তু দুর্গন্ধের ভয়ে কত দিন সুগন্ধী মেখে ঘুড়বেন? কতদিন ময়লা আবর্জনা এখানে সেখানে গুজে রাখবেন?
বের হতে দিন দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধ বের হলেই ঘর পরিষ্কারের তাগিদ হবে। নাকি নোংরা ঘরে নাকে রুমাল গুঁজে বসে থাকাতেই আপনাদের আনন্দ? তবে আমি আপনাদের রুচিবোধ দেখে সত্যিই দুঃখিত। আর আতঙ্কিত এই ভেবে, ঘরে আবর্জনা পুষতে পুষতে না জানি আপনারা নিজেরাই কবে আবর্জনা হয়ে যান।