সৈকত রায়:
যারা লিখছেন মুশফিকা লাইজু কেন এতোদিন ধরে সেলিম আল দীনের নামে অভিযোগ করেননি… স্বকৃত নোমান তো একধাপ এগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও টেনে আনলেন… তারা প্রকারান্তরে এই ছাগলে ভরা বঙ্গভূমির প্রগতিশীলতার নামে ভণ্ডামির প্রকৃত চেহারাই তুলে ধরলেন।
প্রথমত, তারা নিজেরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে এবং এই আমরা যে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি— আমাদের কতটুকু সাহস আছে এই এখনকার হল ও ডিপার্টমেন্টের যেসব সমস্যা মোটা দাগে চোখে পড়ছে তা নিয়ে কথা বলার? এমনকি স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ যখন ছাত্র ছিলেন তখন এনএসএফের দৌরাত্ম্যকারীদের প্রতিবাদ করতে পারেননি। এই যে তারা দলবেঁধে সাধারণ ছাত্র, বিপক্ষ মতের ছেলে মেয়েদের উপর চড়াও হয়, কাপড় ছিড়ে দেয়, তোষক- ট্রাংক ফেলে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বের করে হলে নিজেদের এলাকার বহিরাগত ঢোকায়, সিটপ্রতি ভাড়া নেয় — এসব দেখে হুমায়ূন আহমেদ তখন স্রেফ “আজন্ম সলজ্জ সাধ..” পংক্তির কবিতাটি লিখেছিলেন।

ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ১৯৮৮ বা ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “রজনী”তে, আরো তীব্র খেদ প্রকাশ করেছেন “মাতাল হাওয়া”তে, যা আরো পরে প্রকাশিত।
জনৈকা লাইজুর বিষয়টি তো আরো স্পর্শকাতর, আরো ধাক্কা দেয়। আমরা যদি কাছাকাছি উদাহরণ হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আচরণটি ধরি তাহলে-
ক) হুমায়ূন তখন প্রতিবাদ করতে পারেননি, কারণ তিনি তখনো স্রেফ একজন ছাত্র। এই আমাদেরই মতো। আমাদের তাও ফেসবুক সূত্রে কেউ কেউ চেনে। কিন্তু তখন?
খ) হুমায়ূন তখনই প্রতিবাদ করতে পেরেছেন যখন তিনি হুমায়ূন আহমেদ, প্রথিতযশা টিভি-নাট্যকার, লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অর্থাৎ, তার ব্যাক আপ আছে।
একই বিষয় মুশফিকা লাইজুর ব্যাপারেও। আজ তিনি সেই মফস্বল থেকে আসা প্রথম বর্ষের মেয়েটি নন (এখানে আরেকটি বিষয়, সমাজের চোখে লৈঙ্গিক অবস্থান)।
আমি নিজে যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন দ্বিতীয় বর্ষের সুজন ভাইয়া একদিন দেখা করতে বলেছেন শুনেই আমার পেটের ভাত চাল হয়ে গিয়েছিল। এখনো হলে বড় দাদারা ডাকলে আমার পেটের ক্ষুধা উবে যায়, কিছু পড়তে পারি না। আর মুশফিকা লাইজুর ক্ষেত্রে অভিযোগ আনতে হতো তার ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা আচার্যের কাছে– আমার কি আর কিছু ব্যাখ্যা করার দরকার আছে?
দ্বিতীয়ত, লিট ফেস্টে এই স্বকৃত নোমান সাহেবের বন্ধুরাই “মি টু” নিয়ে বক্তৃতা ঝেড়েছেন।
অদিতি ফাল্গুনী’দি “বাংলা সাহিত্যে নারী ও পুরুষ” শীর্ষক আলোচনায় বলেছিলেন যে, পুরুষদের সবখানে একটি সিন্ডিকেট থাকে। তার পাশে বসা শামীম রেজা হাস্যরসের ছলে কথাটিকে হাল্কা করে দেন। কিন্তু আমি আবার হুমায়ূন আহমেদকেই আনবো (কারণ তিনি আমার প্রিয় লেখক)। তার অসম্ভব মায়ামাখা উপন্যাস “নন্দিত নরকে” প্রথম তিন মাসে দশ বিশ কপিও বিক্রি হয়নি। কারণ তিনি নতুন এক লেখক, তখন “দৈনিক বাংলা” তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত অনেককে দিয়ে বইটির আলোচনার ব্যবস্থা করেন। আর ক্রমে তার পায়ের নিচে মাটি শক্ত হয়।
তো, এটি তো “সিন্ডিকেট” শব্দটির ভদ্রস্থ পরিবেশনাই, নয় কী? এখন সেই সিন্ডিকেট চালাচ্ছি আমরা যারা হুমায়ূন ভক্ত, তারা। কেউ তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করলে তেড়ে ফুড়ে উঠছি, তাঁর সাহিত্যে নবদিগন্ত আবিষ্কার করছি।
একই কথা সেলিম আল দীনকে নিয়ে। যারা জা.বি.র নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পড়তে গিয়েছে, তারা এটা জেনেই গিয়েছে যে উনি এই- সেই। আমি যেমন যতবারই বাংলা বিভাগের সামনে সৌমিত্র শেখর স্যারকে দেখলে বা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাহবুব স্যার, সামিনা লুৎফা ম্যামকে, ISLM বিভাগের কাজী শরীফ স্যারকে দেখলে আপনাআপনিই নতজানু হয়ে যাই… তেমনটিই সেলিম আল দীনের বেলায়ও হয়। তো এমন মানুষ সম্বন্ধে এরকম অভিযোগ এলে অবিশ্বাস প্রথমে ধাক্কা মারবেই। কারণ-
ক) বাঙালি কখনো ভাবতে পারেনা যে মহাপুরুষ বা Hero- গোছের লোকজন মল-মূত্র ত্যাগ, যৌন সঙ্গম করতে পারে। “বাধাই হো” সিনেমায় আয়ুষ্মান খুরানার মতোই বলা চলে, “দ্যাখ্ দোস্ত, এসব (যৌনতা) কি বাপ-মার করার মতো বিষয়!”
খ) আমার /আমাদের সাথে তো এমন করেননি, এমনটি ঘটেনি– তার মানে আর কারোর সাথে তিনি এমন করতে পারেন না?
আমি এখানে নিজের উদাহরণই দিতে চাই।
আমি আমার সাথে পড়ে বা বয়সে অল্প ছোট এমন কিছু মেয়েদের খুব স্নেহ করি। এদের সাথে আমার কথাবার্তা একরকম। আবার এদের সাথে একই ব্যাচে পড়া যাদের আমার দৈহিক দৃষ্টিতে ভাল লাগতো তাদের সাথে একরকম, যাদের মানসিক দৃষ্টিতে আকর্ষিত হতাম সেখানে আরেকরকম করে কথা বলেছি। প্রথম বর্ষে আমার খুব ছটফটানি হতো আর সব মফস্বলের ছেলের মতই যে, এই সবাই “মেয়ে” নিয়ে ঘুরছে, আমারও একজনের হাত ধরতে হবে। হাত ধরার পর মনে হলো হাতে- গালে চুমু খেতে হবে, নয়তো জীবন বৃথা। পারস্পরিক সম্মতিতে হতেই পারে।
কিন্তু এটি তো আর আমি সব মেয়ের সাথে করিনি। যখন কোন বন্ধু মেয়ের সাথে দেখা তখন এসব হাত ধরা বা চুমুর কোন ব্যাপার কথাবার্তা বা আচরণে আসেনি, অথচ তার দশ মিনিট পরেই হয়তো খুব আকর্ষণীয়া কাউকে দেখলাম আর জৈবিকতা আমাকে গ্রাস করলো। ভাগ্যিস আমি প্রভাবশালী কেউ নই, তাই আমার দৌড় ঐ কল্পনায় বালিশে চুমু খেতে খেতে খরচ হয়ে যাওয়া পর্যন্তই ছিল। আর ধন্যবাদ “মি টু” আন্দোলনকে ও সাহসী নারীদের, আমি যদি প্রভাবশালী কেউ হয়ে যাইও, আমার জৈবিকতা পশুত্বে রূপান্তরিত হতে এখন থেকে ভয় পাবে। (এক্ষেত্রে আসলে “মি টু”র আগে আমি যাকে ভালবাসি, যাদের ভালবাসি, ছায়ানট, সিদ্ধেশ্বরী, সংসদ ভবন- এসবের সাথে জড়িত অসাধারণ সব স্মৃতির ভূমিকাই মুখ্য।)
তো মোদ্দা কথা হলো, সবার সাথে আমার সম্পর্ক, ভাবভঙ্গি একইরকম না। সেলিম আল দীনেরও একইরকম হতে অসুবিধা কী?
গ) তার সাহিত্যকর্ম ও প্রেম নিয়ে কথাবার্তা বিষয়ে বলা যায়, আমাদের হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক লেখাগুলো পাঠের পর গুলতেকিন খানের জীবনও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর চাণক্য সেন ছাড়া তেমন কারো আত্মজীবনীতে আমি নিজেদের চরিত্রের বস্তুনিষ্ঠ রূঢ় সমালোচনা পাইনি। সেলিম আল দীনের ব্যাপারেই বা আমরা এতো নিশ্চিত কী করে হই!
ঘ) প্রগতিশীলদের এহেন আচরণ ছাগুমনস্ক, প্রতিক্রিয়াশীলদের চিরাচরিত দোষীকেই দায়ীকরণ মানসিকতাকে সামনে আনে। ঈশা করিম ভাইয়ের ভাষায়, আমাদের…
“আমাদের প্রগতিশীলতার ধারক লোকগুলো যে আসলে পুরুষতান্ত্রিক শয়তান”, সাথে আমি আরো যোগ করি, ছাগু, ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি- গোত্রীয়, সংকীর্ণমনা তা এই “মি টু” আন্দোলন সামনে আনছে। যারা ধর্ষণের বিচারে চারজন সাক্ষী আনার বিষয়টি নিয়ে মজা করতেন, তারাই সেলিম আল দীনের বেলায় সাক্ষী খুঁজছেন।
সবকিছু দেখে এই অর্বাচীনের মনে হয়, সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!