পুরুষালী চোখে ‘নারীমাংস’দের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নাম MeToo

নাসরিন খন্দকার:

হে সেলিম আল দিনের গোপীকূল, ওনার প্রতি আপনাদের অন্ধ প্রেম অতীতের সমস্ত কানাঘুষা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে ছিল, এখনো থাকবে। মরে গেলেই কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে যায় না। তার সৃষ্টি যদি অমর হয়, আপনাদের ভক্তিও যেমন অটুট থাকবে, তেমনি তার কৃতকর্মের ঘা-ও বেঁচে থাকবে মানুষের মনে।

১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি পরীক্ষায় নাটক ও নাট্যতত্ত্বে আমি মেধাতালিকায় থাকার সুযোগ পাই। যেদিন ভর্তির ভাইভা, সেদিন আমি আউটডোর শুটিং স্পট বিকেএসপি থেকে জাহাঙ্গীরনগরে আসি ভাইভা দিতে। আমার ভাইভা নিয়ে শুটিং ক্রুদের মাঝে এবং করিডরে অপেক্ষা করার সময়েই চারপাশ থেকে গুরু সেলিম আল দিনের মদ আর মেয়েমানুষের প্রতি দুর্বলতার কথা নিয়ে নানা রকম হাসাহাসি শুনতে পাই। স্বল্প সময়ের শোবিজের অভিজ্ঞতা (সে কথা হয়তো আরেকদিন বলবো) থেকে আমি এমনিতেই তিক্তবিরক্ত ছিলাম, দোলাচলে ছিলাম অভিনয় চালিয়ে যাবো কী যাবো না সেই নিয়ে। তাই হঠাৎ করেই করিডর থেকেই ভাইভা না দিয়েই ফিরে আসি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেও ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ছিলাম, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্নতত্ত্বেই পবো।

হায়! প্রত্নতত্ত্ব! বিধাতা অজান্তেই মুচকি হাসলেন। টিকতে পারলাম না সেখানেও। সেই কাহিনী ক্যাম্পাসের তখনকার সবার জানা। তৎকালীন প্রত্নতত্ত্বের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (ফিজু) ছিলেন আমার মেজবোন নাসিমা খন্দকারের পরিচিত। পর্যটনের একটা কোর্সে তার সাথে পরিচয়। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার থাকার বিষয়ে আমার পরিবার অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলেন, আর আমি তো ছিলাম সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার স্বপ্নে পাঙ্খা। ফলে আমার আম্মা একরকম জোর করেই আমাকে নিয়ে সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে বিভাগীয় সভাপতির সাথে দেখা করলেন। তিনি আমার আম্মাকে অতি আগ্রহের সাথে জানালেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দেখভালের সব দায়িত্ব তার, এবং তার গাড়িতে করে ক্যাম্পাস দেখালেন। তার অতি আগ্রহ আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু আমার সরল আম্মা রীতিমত মুগ্ধ হয়ে গেলেন তার বদান্যতায়। আম্মার মাথাতেও আসেনি তার টিনএজার মেয়ের প্রতি আগ্রহই মধ্যবয়স্ক এই শিক্ষকের বদান্যতার কারণ হতে পারে।

খুব দ্রুতই তার এই অশালীন অতি আগ্রহ ক্লাসের সবার চোখে পড়লো। বিভাগেও এ নিয়ে হাসাহাসি হতো বলে শুনেছি । আমার প্রাণের বন্ধু লিমাকে ছাড়া আমি পারতপক্ষে বিভাগে যেতাম না, একমুহূর্তও আমাকে একা পাবার সুযোগ দিতাম না। কিন্তু প্রকাশ্যে ফিজুর অতি আগ্রহ, ক্লাসে নানা রকম আকার-ইঙ্গিত, সহপাঠীদের হাসাহাসি, আমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিল। ফিজুর কোর্সে টিউটোরিয়ালে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় আরও বেড়ে গেল যন্ত্রণা।

এর মধ্যে একদিন তার কোর্সে টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় খাতা সাক্ষর করার সময় টের পেলাম তার অযাচিত নৈকট্য, পাথর হয়ে বসে থাকলাম, লিখতে পারিনি একটা অক্ষর। ফিজু একবার রুম থেকে বের হলে সেই সুযোগে ছুটে পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে আসলাম। পরে শুনেছি সে নাকি আমার চলে আসা নিয়ে হম্বিতম্বি করেছে পরীক্ষা হলে।

এর মধ্যে লিমা আমাকে জানালো ওঁর এক বান্ধবীর জন্যে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পরের বছরের ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম এনেছে, কিন্তু সে ফর্ম জমা দেবে না। আমি চাইলে সেটা ব্যবহার করতে পারি। আমি যেন আলোর মুখ দেখলাম। ফর্ম জমা দেবার শেষ দিন পূরণ করে জমা দিলাম। ইচ্ছা নৃবিজ্ঞানে পড়ার, কারণ ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি সেখানকার নারীবাদী পরিবেশের কথা। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম।

তখন আমি ফিজুর কোর্সের কোন পরীক্ষা ও ক্লাস করি না। একদিন তার কোর্সের টিউটোরিয়ালের আগে অন্য একটা ক্লাস ছিল, লিমা প্রস্তুতির জন্যে ক্লাস করবে না, তাই একলাই বিভাগে গেলাম। বিভাগে গিয়ে দেখি সহপাঠীরা কেউ নাই। ক্লাসও সম্ভবত হবে না। তবু আমি বকুল তলায় গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ক্লাসের খবরের জন্যে।

নাসরিন খন্দকার

এমন সময় পেছন থেকে সভাপতির পিওন এসে আমাকে ডাকলেন, বললেন, স্যার আপনাকে ডাকছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম সভাপতির অফিস ঘরে। অফিসের কোনো দরজা ছিল না। শুধু পর্দা দিয়ে সহকারীর বসার জায়গা আলাদা করা। তাই ভাবলাম কিছু ঘটলে দৌড় দেবো বা চিৎকার করবো। তিনি আমাকে বসতে বললেন। বললেন যে আমি শিক্ষার্থী হিসেবে কতো সম্ভাবনাময়, উদ্বিগ্ন হলেন আমার অনুপস্থিতি নিয়ে। তারপর বললেন, শুধু মেধাই না, আমার আরও অনেক কিছু আছে, যা দিয়ে আমি অনেকদূর যেতে পারি যদি উনি আমাকে সাহায্য করেন। আমি টেবিলের অপর প্রান্তে পাথরের মতো মুখ করে বসে হাত দিয়ে ওড়নার ট্যাসেল ছিঁড়তে থাকলাম।
মনে হচ্ছিল তার মুখের সামনে টেবিলটা উপড়ে দিয়ে চলে আসি। বললেন, তার প্রস্তাবের উত্তর পরে জানাতে। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। রিকশা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সোজা হলের পেপার রুমে ঢুকলাম। সেদিনই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের কথা। নৃবিজ্ঞানের উত্তীর্ণদের তালিকায় নিজের রোল নম্বর খুঁজে না পাওয়ায় যখন হাউমাউ করে কাঁদছি, তখনি চোখে পড়লো, একদম পয়লাতেই আমার রোলনম্বর, যা স্বপ্নেও ভাবিনি।

বাড়িতে ফোন করে সোজা জানিয়ে দিলাম, আমি প্রত্নতত্ত্বে পড়বো না, নৃবিজ্ঞানে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি, একবছর বাদ দিয়ে নৃবিজ্ঞানে পড়বো। আমি তখন আনন্দে আটখানা।
কিন্তু তখনো জানতাম না আরও একটা বড় যুদ্ধ আমার সামনে। একবিভাগে ভর্তি থাকা অবস্থায় পরের বছর অন্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্যে দরকার ছিল বিভাগ থেকে ছাড়পত্র। বন্ধুদের নিয়ে সভাপতির কাছে গেলাম, ফিজু জানালো তার ছাড়পত্র দিতে কোন আপত্তি নাই। আমাকে ভর্তির সময়সূচী দেবার সময় আসতে বললেন, বললেন, তিনি ছাড়পত্র তৈরি করে রাখবেন।

ভর্তির দিন ঘোষণা হলো, দশ দিনের মধ্যে ভর্তি হতে হবে। প্রথমদিনই গেলাম তার কাছে, বললেন কয়েকদিন পরে আসতে। সন্দেহ হলো। পরের সপ্তাহে গেলে তিনি এমন ভাব করলেন যে ছাড়পত্রের বিষয়ে তার কিছুই করার নাই, আর তিনি এবিষয়ে কিছু জানেন না, আমাকে একরকম তাড়িয়ে দিলেন।

আমি মরিয়া হয়ে ডীন খালেকুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে আর তৎকালীন নৃবিজ্ঞানের সভাপতির কাছে গেলাম। দুজনেই বললেন এটা বিভাগের বিষয়, বিভাগীয় সভাপতি ছাড়পত্র না দিলে আমি অন্য বিভাগে ভর্তি হতে পারবো না। ডীন আরও বললেন, আবারও বিভাগীয় সভাপতির কাছে আবেদন পত্র নিয়ে যেতে, উনি যদি ছাড়পত্র না দেন, আমি যাতে অনুরোধ করি আবেদন পত্রের উপর তার অসম্মতির কথা লিখে দিতে। তা না হলে ডীন কিছু করতে পারবেন না। গেলাম। এবার আরও বাজেভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। ভর্তি হবার আর মাত্র ২-৩ দিন বাকি তখন। মরিয়া হয়ে আবার ডীনের কাছে গেলাম। তিনি বললেন প্রক্টরের কাছে যেতে। প্রত্নতত্ত্বেরই আরেক শিক্ষক আমার বিষয়টা জানতেন, তিনিও প্রক্টরকে বললেন। প্রক্টর বললেন উপাচার্যের কাছে আবেদন নিয়ে যেতে।

গেলাম। উপাচার্যের সহকারী আমার আবেদন দেখে বললেন, এটা বিভাগীয় বিষয়, সভাপতির সাক্ষর ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবেন না, উপাচার্য তার বিশেষ ক্ষমতাবলে আমাকে ছাড়পত্র দিতে পারেন, কিন্তু সাধারণত তাঁরা এটা করেন না। আমার তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। প্রক্টরের কাছে আবারো গিয়ে কেঁদে ফেললাম, বললাম, আমি যদি বিভাগ বদলাতে না পারি, আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি আমাকে দৌড়ে আবার উপাচার্যের কাছে যেতে বললেন, কারণ উপাচার্য সেদিনই দুই সপ্তাহের জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছেন, পরবর্তী দুই ঘণ্টার মধ্যে তিনি আমাকে ছাড়পত্র না দিলে আমার আর নৃবিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া হবে না। গেলাম, উপাচার্যের অফিসে ওয়েটিং রুমে বসে কাঁদছি, এমন সময় উপাচার্যের সহকারী উপাচার্যের সাক্ষরসহ আমার আবেদনপত্রটি এনে দিলেন, বললেন, আমার ভাগ্য ভালো, আর ফিজুর চরিত্রের কথা সবাই জানে বলেই আমি বিশেষ বিবেচনায় ছাড়পত্র পেলাম। অবশেষে আমি নৃবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম।

তো, এই হলো পুরুষালী জগতে একটি নারীমাংসের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ছোট্ট একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ গল্প। ঠিক যেমন ‘ওপেন সিক্রেট’ সেলিম-আল-দীনের লাম্পট্যের গল্পগুলো। যেখানে প্রত্যেকেই আমরা।

#MeToo

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.