তামান্না আকতার:
অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম কিছু লিখি, কিন্তু সময় ও সুযোগ দুইটার একসাথে সামঞ্জস্যতা বা মানসিক দৃঢ়তা ও হচ্ছিল না। মিটু নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু সত্যি বলতে আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
কার নামে বলবো? এই নামের তালিকা কি লিখে শেষ করা যায়? অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে বিশেষ লাভ কী যদি প্রতিদিন আমাকে এসব নিত্যনতুনভাবে নির্যাতিত হতে হয়। পথে-ঘাটে, অফিসে, মার্কেটে, খাবার দোকানে কোথায় নয়? প্রতিদিন সকালে বের হয়ে সন্ধ্যায় নিজ গৃহে ফেরার আগ পর্যন্ত কোথায় আমি হেনস্তার শিকার হচ্ছি না??
হোক সে রিকশা চালক, হোক সে বাস এর ড্রাইভার, কিংবা বিএমডব্লিও এর মালিক। অফিসের ক্যান্টিন বয় পর্যন্ত আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে পারে! আমার অবস্থান কতটা নিচে! প্রতিদিন সকালে আমি একটা আতংক নিয়ে বের হই আর বাড়ি ফিরে আসি এক রাশ ঘৃণা আর অপমান নিয়ে। প্রতিটা দিন আমার কাছে মনে হয় নতুন একটা করে যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই, নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।
আমার লড়াই নিজের সাথে, আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকা আমাকে প্রতিদিন আবার টেনে তুলি আবার ফিরে যাই কতগুলো ঘৃণিত স্পর্শ, মাথায় ঘোরে কতক উচ্চারিত শব্দ, চোখে ভাসে সাপের বিষের মত বিষাক্ত দৃষ্টিগুলো। কার কার নাম আমি বলবো?? এদের কেউ কারো বাবা, ভাই, ছেলে। আজকে আমি রাস্তায় বের হয়ে হেনস্থা হয়েছি, আগামীকালও হবো, এটা জানি। কেনই বা হবো না, যে সমাজে মেয়েদের খেলার পুতুল বানিয়ে রাখা হয়, তাদের অবস্থা এর চেয়ে আর কি ভালো হতে পারে!
আমার ধারণা অধিকাংশ মেয়েই মিটু নিয়ে কিছু বলতে চাইবে না। কেন? যে দেশে মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই, মেয়েদের সামাজিক কোনো মর্যাদা নেই সেই দেশের মেয়েরা কেন নিজেদের লাঞ্ছনার ইতিহাস বলতে যাবে?? এ যেন শেয়াল এর কাছে মুরগী বর্গা দেয়া। কেননা যখন সে কারো নামে কিছু বলবে, তখন সবাই তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে দেখ ও লাঞ্ছিত হয়েছে। নিজের কথা বলতে যেয়ে আরো বেশি লাঞ্ছিত হবে, কুৎসিত মন্তব্য শুনবে, অন্যের নোংরা কল্পনার খোরাক হবে। কে হতে চায় যেচে অপমানিত হতে?
তাহলে আমি মিটু নিয়ে কখনো কি কথা বলবো না? কারণ বলে লাভ কী? আজকে আমি অজানা ৫০ জন দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছি, কালকে ১০০ জন দ্বারা লাঞ্ছিত হবো, পরশু হয়ত আরো বেশি। আমার বলা না বলায় কিইবা আসে যায়! সত্যি বলতে কী প্রতিদিনের এই নির্যাতন সহ্য হয় না। বাসে-লেগুনায় উঠতে পারি না, রাস্তায় হাঁটতে পারি না, এভাবে আর কয়দিন পারবো নিজেও জানি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, সহ্যের বাঁধ প্রতিদিন একটু একটু করে ভাঙে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি হয় দেশান্তরী হবো, আর না হয় আত্মহত্যার পথ বেছে নেবো, এভাবে একটু একটু করে মরে যাওয়ার চেয়ে একেবারে মরা ভালো।
একটা দেশের রাজধানী কিভাবে এতটা অনিরাপদ হতে পারে?? যেখানে দিনে দুপুরে একটা মেয়ের গায়ে হাত দেয়া যায়, কেউ কিছু বলে না উপরন্তু মজা দেখে। আমি মধ্যবিত্ত, আমার সাধ্য নেই গাড়ি কেনার কিংবা গাড়ি আমার পছন্দ নয়। তাই বলে কি আমি নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবো না? স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার কি আমার নেই? কী জানি হয়তো নেই, এ দেশ মেয়েদের জন্য নয়, এ দেশ মেয়েদের স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য নয়। তাই মিটু নিয়ে কথা বলা আমার জন্য সাগরে এক বালতি পানি ফেলার মতোই হবে।
উপরের লাইনগুলো পড়ে হয়তো আমার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আমি এই সমাজের একজন প্রতিনিধি, আমার মতো আরও পাঁচটা মেয়ে, হোক সে আমার সমবয়সী, বড় কিংবা ছোট তার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম হবে। একজন নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে বলছি, যতদিন পর্যন্ত এই শহর এই দেশ লিঙ্গ, ধর্ম, গোত্র বৈষম্যকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন আমার মতো মেয়েরা ঘরে-বাইরে নির্যাতিত হবে। একটা সময় হয়তো তারা নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলবে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও কালো পর্দার আড়ালে নিরাপত্তা খুঁজে পাবে।
তাহলে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কী? ধরলাম, আমাদের শেখানো হবে নারীকে সম্মান দিতে হবে, কথা হচ্ছে নারীকে কেন সম্মান দেয়া হবে? আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি মানুষকে সম্মান দিতে হবে, সে নারী হোক কিংবা পুরুষ এবং এ শিক্ষাটা আমরা জন্মলগ্ন থেকে পাই, তাহলে নারী যে আলাদা মানব সে চিন্তাটা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে দূর হবে। ঘরে বাইরে শারীরিক মানসিক নির্যাতন হ্রাস পাবে। যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস হবে, প্রতিবাদ হবে, প্রতিরোধ হবে।
বিভেদের গোঁড়ামির যদি মূল উৎপাটন করা যায় তবেই হবে আমাদের আন্দোলন সফল হবে। নাহলে মিটু এর মতো গোটা বিশ্বে সাড়া জাগানো আন্দোলন এদেশে হোঁচট খাবে বার বার।