#MeToo: মরণোত্তর সম্মাননা হলে মরণোত্তর তিরস্কার নয় কেন?

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:

যখন জাঙ্গিয়া দিয়ে বের হয়ে যায় লিঙ্গ মুখ, তখন সেটি ঢাকা দেবার কতো চেষ্টাই না ঘটে। ২০১৮ সালে যখন মুশফিকা লাইজু নিজের ওপর ঘটে যাওয়া অবমামনার কথা জানিয়েছেন, সমাজের সকল ‘মহিয়সী‘ রা তার ওপর হামলে পড়লো। সেখানে ৩১ বছর অাগে কেন তিনি এই ঘটনাটি জানাননি, সেটা বোধকরি কারও বোঝার বাকি থাকে না!

অামি অবাক হচ্ছি, সত্যিই অবাক হচ্ছি!!! একটি লেখাকে আপনারা কী থেকে কী বানিয়ে দিলেন!! একটি অান্দোলনকে আপনারা কেমন করে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেললেন?

মুশফিকা লাইজু কোথায় লিখেছেন যে তিনি তার প্রেমিককে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গিয়েছিলেন যে আপনারা আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করছেন কেন প্রেমিককেও স্যারের বাসায় নিয়ে যাননি? অাপনারা যখন সেলিম আল দীনে মুগ্ধ হয়ে কলম চালাবেন, তখন প্রথমেই যার লেখার নিন্দা বা প্রতিবাদ করে বলতেন চাইছেন, সেটি পড়ে সঠিক তথ্যটি অাগে জানা অাবশ্যক নয় কি?
উনি বলেছেন, বন্ধু, প্রেমিক নয়। এখন অাপনাদের প্রশ্ন হলো, প্রেমিক বা বন্ধু যেই হোক না কেন, তাকে স্যারের বাসায় কেন নিয়ে যাননি? ধরেন, অাপনাকে যখন কেউ দাওয়াত করে বা আপনি কারও বাসায় কোন কাজে গেলেন, তো অাপনি কি করেন? অাপনার বন্ধু/স্বজন/প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সেখানে নিয়ে যান, তাই তো? যদি নিয়ে যান, তবে প্রশ্ন হলো, কেন নিয়ে যান? আপনাকে কি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে? আর যদি না নিয়ে যান তবে প্রশ্ন হলো, আপনি নিজে যা করেন না, সেটি অন্যে করেননি বলে টুঁটি চেপে কেন ধরছেন?

সস্তা প্রচারের কথা বলেছেন না আপনারা? মনে করেন আপনার একটি মেয়ে আছে, এমন ঘুণে ধরা সমাজে তাকে হয়তো বিয়েও দিতে হবে বা ইতোমধ্যেই হয়েছে, এরকম একটি সময়ে এসে ‘সস্তা প্রচার‘ এর জন্য আপনি এমন ধরনের অভিযোগ করবেন যাতে কিনা আপনার মেয়ে ভবিষ্যত বা পারিবারিক জীবন কিংবা আপনার পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়?

কেন এতো বছর না বলে এখন বলছেন? এটা এক ধরনের রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ!! বলবেন এতো বছর পর আবার কীসের প্রতিরোধ? অনেকদিনের জমে থাকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সুযোগ পেয়েই মুখ খুলেছেন। এই মুখ খোলায় তার কী ফায়দা হবে? ছি ছি, খামাখা মৃত মানুষের নামে অপবাদ!! তাই তো? তিনি কোনদিন কাউকে কম নাম্বার দিতে পারেন না, বের করে দিতে পারেন না!! একজন শিক্ষকের কত ক্ষমতা থাকতে পারে, আপনি জানেন? সেই ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগও আমাদের দেশে বিস্তর। কারণ আপনি যদি অভিযোগ করেন, তবে তদন্তকারীও কোন না কোন শিক্ষক, যারা হয়তো কোন না কোন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত হচ্ছে।

শোনেন, কোন শিক্ষার্থী শুধুমাত্র অপছন্দের সহকর্মীর পছন্দের হলে বা তার থিসিস স্টুডেন্ট হলে, অন্য আরেকজন তার কোর্সে কম নাম্বার দেয়ার অদৃশ্য চল এবং ক্ষমতা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। প্রমাণ? হাসালেন আমাদের!! কেন হাসি পাচ্ছে? আপনাদের না বোঝার, না জানার ভাব দেখে হাসি পাচ্ছে!!

মুশফিকা লাইজু মুখ খুলেছেন, কারণ ভবিষ্যতে যেন কোন গুরু, শিক্ষক কিংবা অন্য কোন নিপীড়ক, একটু চিন্তা করেন, কিংবা আরও হাজারটা মেয়ে যেন সাবধান হতে পারে।

অাপনারা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই বলছেন যে, ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বানোয়াট; আবার সেই আপনারাই বলছেন যে, ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সত্য নাকি জানা যাবে? বিপরীতধর্মী কথা!!! নয় কি?? অথবা তারা যা বলবে তাই কি আপনারা বিশ্বাস করবেন নাকি করবেন না? আসলে আপনাদের কাছে সত্য বা মিথ্যা কি?? অাপনাদের কাছে সত্য হলো সেটিই যেটি আপনারা শুনতে চাচ্ছেন আর তার বিপরীতটিই হলো মিথ্যা!!

সেলিম আল দীন বেঁচে নেই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য!!! তাতে কী ক্ষতি হয়েছে? আপনারা তো আছেন তার হয়ে লড়েই করবার জন্য। আর ৩১ বছর উনি কেন চুপ ছিলেন আর লড়াইটা করে উঠতে পারেননি সেটা তাঁর ব্যাখ্যায় রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা না পড়ে যদি শুধুমাত্র আপনাদের নিজেদের লেখা এবং তার সমর্থনের মন্তব্যের ধরন আর ভাষা দেখেন, তবেই কিন্তু সহজের বোধগম্য হবে কেন উনি বা ওনার মতো কেউ সহজে মুখ খুলতে চান না। একজন গুণী মানুষকে যদি মুত্যুর পর সম্মাননা দেয়া যায়, তবে তার মৃত্যুর পর কেউ সুযোগ পেলে তার অন্ধকার দিকটি আলোতে অানতে পারবে না?

আপনাদের প্রিয় শিক্ষকের ’সম্মানহানিতে’ আপনারা ক্ষুদ্ধ এবং মর্মাহত, বুঝলাম। কিন্তু আপনাদের লেখার মধ্যে তেমন কোন যুক্তি নেই!! যুক্তি গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে নির্মোহ হওয়া প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত এই সব সামাজিক- সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ায় আমাদের দেখার-বোঝার-জানার-শেখার ইন্দ্রিয়গুলো পরিণত হয়, ধারণা ভেঙেচুরে নতুন ধারণার জন্ম হয়। তিনি আপনাদের শ্রদ্ধেয়, তাঁর কাজের শিল্পমান এ আলোচনায় বা সমালোচনায় তো কমছে না সেটি আপনাদের বুঝতে হবে। কিন্তু, সেজন্য মানুষ হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর প্রশ্নে কারোরই অব্যাহতি নেই। সব ঘটনা যেমন প্রমাণযোগ্য নয়, তেমনি সব অভিযোগও সত্য নয় । প্রশ্ন-তর্ক- সন্দেহ- অভিযোগ গ্রহণ করলে তবেই আমাদের সব সীমাবদ্ধতাকে চেনার সুযোগ হবে, মানুষ হিসাবে উত্তরণের পথ তৈরি হবে।

ভক্তিবাদ থেকে না বেরোতে পারলে অাপনি বা অামি, কখনই কিন্তু সত্যিটা দেখতে পারবো না!! সূর্যদেবকে মনভরে ভক্তি করেন, কারণ উনি আলো দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এবার বাস্তবতায় আসুন, কিছুক্ষণের জন্য ভক্তিবাদ থেকে বের হয়ে। বায়ুস্তর একটিও না থাকলে নিমিষেই সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করার ক্ষমতাও কিন্তু তার রয়েছে।

তাই আসুন আমরা ভক্তিবাদ থেকে নিজেদের রেহাই দিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি হতে শিখি এবং কঠিন বাস্তব প্রকাশের রাস্তাকে কিছুটা হলেও সহজ করতে সহায়তা করি। পাশে না দাঁড়াতে পারেন কোন সমস্যা নেই, কারও ক্ষত সারাতে না পারেন, সমস্যা নেই, কিন্তু নিপীড়িতদের বেহুদা উলঙ্গ করার অানন্দে নাচবেন না।

#MeTooBangladesh

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.