রনিয়া রহিম:
ইমোশনাল এবিউজ নিয়ে কাজ করা একজন সাইকোথেরাপিস্টের মতে ৮টি কারণে যৌন-নিপীড়নের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী সহজে সামনে আসেন না: ১) লজ্জা; ২) নিজের কাছেই অস্বীকার করা; ৩) পরিণামের ভয় করা; ৪) আত্মবিশ্বাস-হীনতায় ভোগা; ৫) নৈরাশ্য; ৬) এমন নিপীড়নের শিকার আগেও হওয়া; ৭) কি করতে হবে বা কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেসবের তথ্য না থাকা; এবং ৮) স্মৃতি বিলুপ্তি বা বিচ্যুতি ঘটা।
আমি আমার একটি গল্প বলি। আমার তখন বালিকাবেলা, – বাংলাদেশে থাকি। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের একজনের বিয়ে, আমরা দলবেঁধে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেমেছে ফেরী ঘাটে, আমি বাবার হাত ধরে বাস থেকে নেমে ফেরীর দিকে যাচ্ছি। বেশ রাত তখন, কিন্তু প্রচুর মানুষ সেখানে। সেই ভিড়ের মধ্যে উল্টোদিক থেকে আসা এক লোক খুব দ্রুত আমার দুই ঊরুর মাঝখানে হাত দিলো, ছুঁলো, তারপর ভিড়ের মাঝে মিলিয়েও গেলো। আমি বাবার হাত ধরা ছিলাম,- আগে, তখন, পরেও। এতো অবাক হয়ে গেলাম যে কিছু বলতেও পারলাম না। আব্বুকে না, আর বাসভর্তি আত্মীয়-স্বজনদের একজনকেও না। ভয় আর লজ্জার মিলিত সংমিশ্রণ সব একসাথে হয়েছিলো। সেদিন সারা রাত কাউকে বলিনি, এতো বছরেও বলিনি, – বলেছিলাম যখন দুই বছর আগে আমেরিকায় প্রথম মি-টু’র ছোঁয়া এসে লাগে। ঘটনাটা ভুলেও গিয়েছিলাম, এই আন্দোলনের সূত্র ধরে মনে পড়ে। এবং বলার সময়েও বলেছিলাম এমন ভাবে, – অনেকের অনেক কিছু হয়, আমার তেমন কিছুই হয়নি, এটা অবশ্য হয়েছিলো। আমার সেই স্ট্যাটাসটা পড়ে এক আমেরিকান বান্ধবী তৎক্ষণাৎ ফোন দিয়ে বলেছিলো, তুমি এমন তুচ্ছ করে বলছো কেন? এটা তো বিরাট কিছু, – আর এটা তো খুব অন্যায়।
কী কারণে ভুক্তভোগীরা মুখ খোলে না, আমার এত্তবছর আগের ‘ছোট্ট’ একটা স্মৃতি দিয়ে উদাহরণ দিলাম। সে নিপীড়ক একজন অচেনা মানুষ ছিলো, ভিড়ের মধ্যে যার চেহারাও আমি দেখিনি। সে যদি খুব নামকরা কেউ হতো; প্রভাবশালী কেউ হতো; যার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাকিরা মানা করছে; বা যার কথা কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলে আমার মনে হচ্ছে; বা মুখ খুলেছি কয়েকজনের কাছে কিন্তু লাভ হয়নি; বরং সেই নিপীড়ক আমাকে আরো বিভিন্ন ভাবে এবিউজ করছে তার কথা ও কাজে; – আমাকে হুমকি দিচ্ছে বা আমার কোন রকমের ক্ষতি করার ভয় দেখাচ্ছে, বা করছেও ক্ষতি; আইনের আশ্রয় নিয়ে আমার কোন সাহায্য হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না; আমি কারো কাছ থেকে কোন সাপোর্ট পাচ্ছি না; – আমি হলে কী করতাম? আমি কি তবুও মুখ খুলতাম?
একে তো কষ্ট, লজ্জা, ভয়, নিরাশা, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, এমন হাজার জিনিসের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি সেই নিপীড়কের কারণে, তার উপর মুখ খোলার মতো আমার যখন কোন ক্ষেত্র নেই, – আমি কেন তাহলে মুখ খুলতাম?
#
এখন মনে করুন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যখন সারা পৃথিবীর আমার হাতের মুঠোয়, আমি দেখছি, দেশ-বিদেশ থেকে নানান ভুক্তভোগী তাদের নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে। কিছু কিছু লেখা দেখে আমারও মনে হচ্ছে, – আমি একা নই। আমার সাথেও এমন হয়েছিল। আজকে আমার নিপীড়ক সমাজে খুব সম্মানিত, সেটি তার বর্তমানে কিংবা মরণোত্তরে, কিন্তু সে যে আমার কী দুর্বিষহ ক্ষতি করেছিল কেউ জানে না। আমি এখন একটু বলতে চাই, এতোদিন যে বোঝা আমি একা বয়ে বেরিয়েছি সেটি বলে আমি একটু হালকা হতে চাই। আমি ন্যায়বিচার পাই কি না পাই, – আমি হয়তো এতদিনে সেটি আর আশাও করি না, – কিন্তু অনেক হয়েছে, আর না, এদের কীর্তিগুলো আড়ালে থেকে যায় বলে সমাজের বিভিন্ন আনাচে কানাচে এমন অনেক ভুক্তভোগী রয়ে যায়, – আমি তাই বলতে চাই। আমার শান্তি হোক; আদালতে না হোক, জীবনের হালখাতাতেও যদি হয় তো কোথাও একটু সুবিচার হোক; আর কারো সহায়তাও যদি হয়, সেটি হবে বোনাস।
মনে করুন আমার কথাগুলো আমি বললাম। আমি যে রনিয়া রহিম, অদেখা এক মানুষের নিপীড়নের কথা বললাম, এতে কেউ আমার প্রতি আঙ্গুল তুলবে না, বরং অনেকেরই সহমর্মিতা আমি পাবো। আমি যদি শুধু আমার চেনা কোন মানুষের দিকে আঙ্গুল তুলি, যার পরিচিতির গন্ডি বিস্তারিত নয়, আমি তখন হয়তো সহানুভূতি পাবো। কিন্তু আমি যেই মুহূর্তে আমি দোষারোপ করবো খুবই নামীদামী কারো প্রতি, – প্রভাবশালী কিংবা তার বাকি সব কর্মগুণে হরেক মানুষের প্রিয় কারো প্রতি, – তখন কী হবে? তখন আঙ্গুল উঠবে কি সেই নিপীড়কের প্রতি নাকি আমার দিকেই বাকিরা মুষ্ঠি হাতে এগিয়ে আসবেন আমাকে ধুয়ে দিয়ে আমাকে জন্মের মতো সোজা করে দিতে?
#মিটু কোন সহজ আন্দোলন নয়। এখানে অনেকরকমের মনভাঙ্গনের গল্প জড়িত, – কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে, বাঙালি হিসেবে, আমার মাথা হেঁট হচ্ছে যখন আপনারা অনেকেই এই মনভাঙ্গা মানুষদের তাদের গল্পগুলো বলতে দিচ্ছেন না। তাকে বিশ্বাস তো করছেনই না, তাকে বেনিফিট অফ ডাউটটা পর্যন্ত দিচ্ছেন না, – উল্টো অবিশ্বাসের মোড়কে তারই চরিত্রহানি করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
ছিঃ! – আপনাদের ধিক্কার! আজ যদি আপনার পরিবারের কারও বিরুদ্ধে আঙ্গুল ওঠে, কিংবা আপনার কাছের কোন বন্ধুকে নিয়ে কথা ওঠে, – আমি তবুও বুঝতে পারি আপনার বিশ্বাসে ধাক্কা লাগার কারণ। কিন্তু কোন মানুষ খ্যাতিমান বলেই কী এমন শর্তহীন বিশ্বাস তাকে দেবেন কি? সেই সঙ্গে এটাও কি বোঝা খুব কঠিন, একজন মানুষ আপনার সাথে খুব চমৎকার হতে পারে, কিন্তু আরেকজন মানুষের প্রতি তার আচরণ ন্যাক্কারজনক হতেই পারে; – আপনার কাছে দেবতুল্য বলেই কি সে আসলেই দেবতা হয়ে যায়?
#
আমার এক বন্ধু ছিলো, যে একসময় খুবই হালকা ভাবে ধর্ষণ নিয়ে হাসিঠাট্টা করতো। আমি প্রত্যেকবারই তাকে থামাতাম, তাকে ধমকাতাম। একদিন সে খুব সিরিয়াসলি আমার কাছে এসে জানতে চাইলো, – “আমি দুঃখিত, আমি তো আসলে এমনি এমনি বলি, কিন্তু তুমি এমন এফেক্টেড হয়ে যাও, – আমি দুঃখিত যদি তোমার জীবনে এমন কোন গল্প থেকে থাকে, আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি।” আমি বললাম, দেখো, সরাসরি আমার জীবনে এমন কোন ঘটনা নেই। কিন্তু তুমি ভরা মজলিশে যে এইসব বলো, এখানে তো আরো অনেকেই থাকে, তুমি কি করে জানো কার আছে, আর কার নেই। তুমি যতবার এই জোকগুলো করো, তুমি হয়তো কারো দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে নিয়ে আসো, – এটি কি উচিত?
সে সেদিন বুঝেছিলো, এরপর থেকে এমন থার্ড-ক্লাস রসিকতা সে আর কখনোই করেনি। আমি একই কথা আপনাদেরকেও বলি, আজকে হয়তো নামকরা কারো বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ শুনে আপনি হাসাহাসি করছেন সেই ভুক্তভোগীকে নিয়ে, তাকে অবিশ্বাস করছেন, তার মুখ খোলার নেপথ্যে কি স্বার্থপর কারণ থাকতে পারে সেই গবেষণা করছেন।
আপনার এই কথাগুলো শুনছে কারা? আপনার কাছের মানুষগুলো! তারা নিজেরা যদি কোনোরকমের নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে, এই মানুষগুলো কি আপনার কাছে এসে মনখুলে বলার আস্থা পাবে? আপনি হয়তো আপনার সর্বোচ্চ সহায়তা দিতেন তাদের, – কিন্তু আপনার আজকের এই আলোচনাগুলো দেখে কি তারা আর ভরসা পাচ্ছে!?
মিটু’র আন্দোলনে যারা নিজের ভয়/ক্ষোভ/কষ্ট/লজ্জা/আশাহীনতা সরিয়ে রেখে সাহস করে নিজের গল্পগুলো বলছেন, তারা কেবল নিজেদের জন্য না, – তারা মশাল জ্বালাচ্ছেন একটি শুভ আগামীর জন্য। যে আগামীতে সচেতনতা আছে, সহায়তা আছে, সহমর্মিতা আছে, সংহতি আছে। সেই মশাল নেভানোর চেষ্টা আজ যদি করে থাকেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আপনি ইতিহাসের উল্টোদিকে একদিন অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতে বাধ্য।