দিলশানা পারুল:
সেলিম আল দীন যৌন নিপীড়ক ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে দুইটা কথা বলা নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি। সেই দুইটা কথা বলার আগে নিজের জাবি সংশ্লিষ্ট পরিচয়টা একটু ভালো করে দিয়ে নেই, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আমার জন্ম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে। জীবনের আটাশ বছর পার করে এসেছি ক্যাম্পাসে, তার পরে বের হয়েছি। ওনার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা ম্যাডাম আমাদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন দীর্ঘদিন।
এইবার ঘটনায় আসি। সেলিম আল দীন যে যৌন নিপীড়ক ছিলেন, এইটা কিন্তু ক্যাম্পাস আবাসিক এলাকায় কোন গোপন বিষয় ছিলো না। আমরা যখন খুব ছোট টু কী থ্রিতে পড়ি, খুব ভালো করে বিষয়টা বুঝিও না, তখন থেকেই বিষয়টা শুনে এসছি আমরা। অনেক চাচীরাই গোপনে কানাঘুষা করতেন বিষয়টা নিয়ে। তবে কেউ উচ্চবাচ্চ্য করতেন না। উচ্চবাচ্য করতেন না, কারণ উচ্চবাচ্যের সেই কালচার আমাদের সমাজে তখনও ছিলো না, এখনো নেই।
আমি স্কুলে থাকতে খুব ভালো নাচ করতাম, আবৃত্তি করতাম, মঞ্চ নাটকে দুই দুইবার রৌপ্য পদক পেয়েছি, কাজেই আমার খুবই ইচ্ছা ছিলো নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হবো। আমি ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে প্রথম হই, কিন্তু আমার আব্বা এবং মুরুব্বী বোন যিনি জাবি ১৮ ব্যাচ ছিলেন, আমাকে কোনমতেই সেই বিভাগে ভর্তি হতে দেয়নি। ভর্তি হতে দেয়নি, কারণ তখন তারা সেলিম আল দীনসহ আরও কিছু শিক্ষক বিষয়ে এই সমস্ত কান কাহিনী জানে।
এইবার আসি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রফ্রন্ট করার সুবাদে এই সমস্ত ঘটনা অহরহ কানে আসতো। গণরুমে প্রথম বর্ষে পড়ুয়া মেয়েগুলোর কাছে অনকে ধরনের স্টোরি শুনতে হতো, কিন্তু কখনোই কিছু করা যায় নাই। কারণ কোনো ভিকটিম কখনো মুখ খুলতো না উনার বা ওই বিভাগের অন্য শিক্ষকের নামে। মেয়েগুলোর মুখ না খোলার পিছনে প্রধান ভূমিকা রাখতো বিভাগের সিনিয়র ভাই এবং বোনরা, যারা উনার বিরাট ভক্ত, উনাকে গুরু মানেন বা বাবা মানেন। সেই গ্রুপটা তখনও সক্রিয় ছিলো এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এখনো একইভাবে সক্রিয় আছে।
সেলিম আল দীন অসম্ভব প্রতিভাবান একজন নাট্যকার ছিলেন, উনার নাটক যে দেখেনি সে আসলে বুঝবে না সেই প্রতিভা কোন স্তরের! কিন্তু তাতে উনি যে যৌন নিপীড়ক ছিলেন সেইটা খারিজ হয়ে যায় না। প্রতিভার সাথে যৌন নিপীড়নের কোনো বিরোধ নাই। যিনি বিরাট প্রতিভাবান, তিনি বিরাট মাপের যৌন নিপীড়ক হইতেই পারেন।
আর হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন কোনো বিচার চাই আন্দোলন না, যে আইনের কাছে প্রমাণ দিতে হবে। হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন মেয়েদের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সাহসী করে তোলার আন্দোলন। এই্ আন্দোলন বলে নিপীড়কের নামটা বলে দাও, নিপীড়ককে অন্তত সামাজিক লজ্জায় ফেলো। এই আন্দোলন যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমাজকে সচেতন করে তোলার আন্দোলন।
এই আন্দোলন দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের সমাজে যৌন নির্যাতন কী ভয়াবহ আকারে আছে! কী পরিমাণ মুখোশ পরা সাধু লোকজন আসলে কী কুতসিৎ চরিত্রের হতে পারে। মিটু আন্দোলনে ভিকটিম তার পূর্ব অভিজ্ঞতাই শেয়ার করছে। পরিতাপ নিয়ে শিক্ষিত সমাজকে বলতে হচ্ছে, যৌন নিপীড়ক কোনদিন কোন প্রমাণ রেখে নিপীড়ন করে না। প্রমাণ থাকার সম্ভাবনা থাকলে সে নিপীড়ন করবে না। কাজেই যৌন নিপীড়নের প্রমাণ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না, নিজেও লজ্জায় পরিবেন না।