সুচিত্রা সরকার:
মেয়েটাকে অতোটাও চিনতাম না যে, আজ স্মরণ করতে হবে! তবে মেয়েটা যা করেছে- আজ, কাল, পরশু কেন- সারাজীবন ওকে মনে রাখবো। যতদিন গয়না নিয়ে মেয়েদের দর উঠবে নামবে, ততদিন স্মৃতি মেয়েটিকে ভুলতে দেবে না।
ঘটনা ছোট। এক নি:শ্বাসে বলার চেষ্টা করি! বিয়ের আগে বরপক্ষ টাকা পয়সার সঙ্গে পাঁচ ভরি গয়নাও চেয়েছিল। না, বর পরবে, এ কারণে নয়। মেয়ের শরীরে জড়িয়ে দিতে হবে।
মেয়ের দুই ভাই ওমান দেশে থাকে বহুদিন ধরে। সামর্থ্য কম, এমনটা নয়। কিন্তু যেহেতু- হারজিতের প্রশ্ন আছে গয়নার সঙ্গে, মেয়ের ভাইয়েরা বিষয়টা ঝুলিয়ে দিলো। তারা বললো, বিয়ের সময় নগদ এক লক্ষ টাকা দেয়া হবে। তবে গয়নাটা কিছুদিন পরে!
বিয়ের মাস পার না হতেই মেয়ে পৃথিবীতে আরেকজনকে আনতে চলেছে। এবার ভাইয়েরা গয়না দিল। বরপক্ষ খুশি।
তারপর মেয়ের সন্তান বাবার বাড়িতেই হবে, সিদ্ধান্ত হলো। সন্তান হবার আগে মেয়ের অবস্থা ভয়ানক নাজুক হয়ে গেল। এই মরে, সেই মরে! তখন মেয়ের বাবা, তার চিকিৎসার জন্য মেয়ের গয়নাগুলোই বিক্রি করলেন! নতুন সদস্য এলো! সকলে সব ভুলে গেল।
তারপর বরপক্ষ গয়না ফেরত চাইলো। কনেপক্ষ বললো, ও তো তোমার ছেলে হতে গিয়েই খরচ হয়েছে। বরপক্ষের যুক্তি, এ হবে না। এসব খরচ করলেন কেন? একদিন রাগের বশে বর, শ্বশুর, ননদ মিলে আচ্ছাসে ধোলাই দিল মেয়েটিকে।

বোকা মেয়ের সব রাগ গিয়ে পড়লো বাবা- মায়ের উপর। সে তখনই রওনা দিল বাবার বাড়িতে। এবং বাবার বাড়ির দালান-বাড়ির ফ্যানে ঝুলিয়ে দিল তার শরীর! কাহিনি খতম! খাল্লাশ!
অপর্ণা সেনের গয়নার বাক্স সিনেমাটা দেখেছেন? এক বৃদ্ধার গয়নার বাক্সে তাল তাল গয়না। আর এই গয়নার জোরেই বৃদ্ধা সংসারে ঠাঁই পায়, পায় মর্যাদা!
মর্যাদা না ছাই! কচুপোড়ার মর্যাদা এটা।
এবার কল্পনা করুন কয়েকটা দৃশ্য!
বিয়ের আগে গয়নার দোকানে ভিড় করছে ছেলেরা। চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে। পছন্দসই কানের দুল, কানফুল, সীতাহার, বাজুবন্ধ, নূপুর কিনছে। না, অন্য কারো জন্য নয়। কিনছে নিজে পরবে বলে।
বিয়েতে এখন তো যৌতুকের চল নেই। খবর পেলে পুলিশ ধরবে বলে! এখন উপহারের চল। তা সেই উপহারের মধ্যে ছেলেদের গয়না দেয়া প্রচলিত আইন হয়েছে। মেয়ের মা ছেলেকে আশীর্বাদ করতে এসে পাঁচ-ছ’ ভরি গয়না পরিয়ে গেলেন ছেলেকে। অথবা বাসর রাতে কনে, তার প্রিয় বরকে উপহার দিল একটা নেকলেস!
কল্পনাটা কি শক্ত বেশি?
আচ্ছা এবার আরেকটু কষ্ট করুন। যে মেয়েটার গল্প বললাম, মেয়েটার জায়গায় একটা ছেলেকে বসিয়ে দিন। ছেলেটাকে বিয়েতে গয়না দেয়নি বলে সে ফ্যানে দেহটা ঝুলিয়ে দিল।
উৎসবে মেয়েরা নয়, ছেলেরা নতুন নতুন গয়না পরে অন্যদের দেখাচ্ছে! কল্পনা করা যাচ্ছে?
যদি এসব কল্পনা কঠিন হয়, তবে অন্য কল্পনা করুন। যেমন একটি পরিবার। সেখানে একটা মেয়ে সম্পত্তির বেশি অংশ পাবে। আর যে ধর্মে মেয়েটি কিছুই পাচ্ছে না, সেখানে মেয়েরাই সব পাচ্ছে, ছেলেরা আমের আঁটি!
তখন কি হবে, জানেন? গয়নার প্রতি ছেলেদের আগ্রহ যাবে বেড়ে! ঘরে ঘরে গয়নার রাজনীতিতে তখন মেয়েরা নয়, ছেলেরা যুক্ত হবে। সম্পত্তিতে সমান অধিকার নেই যে! তারা সোনা, হিরে, জহরত পেলে- গোলাম হয়ে যাবে অন্যের! ভবিষ্যতের চিন্তায় একটু একটু করে গয়না জমাবে। আর স্ত্রীর কাছে বায়না করবে, এই শুনছো, এ মাসে আমাকে একটা টিকলি গড়িয়ে দাও না গো’!
যদি পড়তে পড়তে হাসি চলে আসে, তবে অন্য একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। পৃথিবীর সকল স্থানে, সব ধর্মে, সকল আইনে মেয়েদের যতটা সম্পত্তি দেয়া হচ্ছে, পুরুষদেরও ততটাই। এক চুল কম নয়, বেশিও নয়।
তখন গয়না মানেই স্ত্রীধন, কথাটা জাদুঘরে ঠাঁই পাবে। লোকে পড়বে, তবে ফ্যাশন বা স্টাইল অর্থে! গৌরব বা বিপদের কান্ডারী হিসেবে নয়! মর্যাদার অলংকার হিসেবে নয়।
দিন নাকি এতো পাল্টেছে! মানুষ রোবটের হাতে খাবার খাচ্ছে। মঙ্গলে জল পাওয়া যাচ্ছে! তো এবার মেয়েদের শেকল পড়ানোর ছলটা ভাঙুন না! গয়নার নামে মেয়েদের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে চলা ভাঁওতাবাজি বন্ধ করুন। গয়না নয়, মেয়েদের মর্যাদা দিতে শিখুন। সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার দিন! দয়া করে গয়নার রাজনীতি থেকে মেয়েদের বেরোতে দিন। তাহলে গয়নার বাক্সের গল্পটার অন্তত ইতি ঘটবে!
১১.১১.২০১৮
১০.৪৯ মিনিট
লালবাগ, ঢাকা