যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুর সুরক্ষা: কী করতে পারেন মা-বাবারা

লায়লা খন্দকার:

শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন: কিছু ভুল ধারণা ও বাস্তবতা

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি- সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত দেশে শিশু ধর্ষণ ঘটেছে ৪৯৪টি। এ শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের হিসেব। প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, শিশুরা অপরিচিত মানুষদের দ্বারাই নিপীড়িত হয় এবং শুধু মেয়ে শিশুরাই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কেউ কেউ ভাবেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আকর্ষণীয় শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

অপরাধীদের নিয়েও প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যেমন অনেকের ধারণা শুধু বাইরের পুরুষেরাই শিশুদের নিপীড়ন করে থাকেন। কিন্তু বিশ্বের নানা অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শিশুর পরিচিত ও অপরিচিত জন, এমনকি আত্মীয়রাও নিপীড়ক হতে পারেন এবং নারীরাও শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন করে থাকেন। কখনো আবার অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিশুরা (ছেলে কিংবা মেয়ে) কম বয়স্ক শিশুদের নিপীড়ন করতে পারে। গ্রাম কিংবা শহরের যেকোনো সামাজিক অবস্থান এবং যেকোনো বয়সের শিশুরা নিপীড়নের শিকার হতে পারে। প্রতিবন্ধী শিশু, পথে বসবাসকারী শিশুদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি। শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন নানাভাবে ঘটতে পারে। অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত।

শিশুর ওপর যৌন নিপীড়নের প্রভাব

শিশুদের জীবনে যৌন নিপীড়ন খুবই গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রভাব একেক শিশুর ওপর একেক রকম হতে দেখা যায়। নিপীড়নের শিকার শিশুরা ভয়, উৎকণ্ঠা, অবসাদ, ক্রোধ ইত্যাদিতে ভুগতে পারে। স্কুলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব দেখা দেওয়ার আশংকা থাকে। এমনকি তাদের যৌন আচরণেও অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে, যা বয়সের সঙ্গে মানানসই নয়। এছাড়া অসামাজিক কাজে জড়ানো, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া, নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে অপারগতার মতো সমস্যাও হতে পারে।

শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন রোধে মা-বাবার করণীয়

মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের উচিত শিশুদের বুঝিয়ে বলা যে, কেউ যদি শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ করে যাতে সে অস্বস্তিবোধ করে, তাহলে সে ‘না’ বলতে পারে; এমনকি সেই ব্যক্তি যদি শিশুর কাছের কেউ হন তবুও। সেই সঙ্গে এটাও বলা, এমন কিছু ঘটলে শিশুদের তা বড়দের জানাতে পারবে। মা-বাবার খেয়াল করা উচিত শিশুটি কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলছে কিনা। এমন হলে তার পেছনের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে হবে, এবং কোনোভাবেই শিশুটিকে সেই ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রাখতে বাধ্য করা যাবে না। আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের কোলে বসা, চুমু খাওয়া কিংবা আদর করার জন্য শিশুদের জোর করা উচিত নয়।

শিশু নিপীড়নের শিকার হলে তাকে আশ্বস্ত করুন, এ ঘটনার জন্য সে দায়ী নয়। বরং নিপীড়নকারী ব্যক্তিটিই দোষী এবং তার এই আচরণ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদেরকে আরও বলতে হবে, কেউ যদি গোপনে তাদের কোনো উপহার দেয় তবে সেটা পরিবারের বড়দের জানাতে হবে এবং এই উপহারের বিনিময়ে সে কোনো কিছু করতে বাধ্য নয়।

শিশু নিপীড়নের শিকার হলে কী করবেন

অভিভাবক ও যত্নকারীদের জেনে রাখা উচিত কোনো শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হলে কী করতে হবে। প্রথমেই তাদের করণীয় হলো, শিশুদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা এবং নিজেদের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই নিপীড়নকারীকে সমর্থন করা যাবে না। শিশুটিকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, এই ঘটনার জন্য কোনোভাবেই সে দায়ী নয় এবং তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুটিকে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তা দিতে হবে। অন্যান্য অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের নিপীড়নকারী সম্পর্কে জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে তারা নিজেদের শিশুদের বেলায় সতর্ক থাকতে পারেন।

শিশুদের বুঝতে দেয়া যাবে না যে বড়রা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন। বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানো, শিশুটিকে অনেক প্রশ্ন করা কিংবা তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কিছু করা যাতে শিশুটি অস্বস্তিবোধ করে, ভয় কিংবা বিরক্তি প্রদর্শন করা, ঘটনাটি তুচ্ছ করে দেখা কিংবা নিপীড়নকারীর পক্ষ নেওয়া একদমই উচিত নয়। এ ধরনের আচরণ শিশুটির জন্য খুবই নেতিবাচক হতে পারে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটি ভয় কিংবা লজ্জায় নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু বড়রা এটি বুঝে নিতে পারেন শিশুর মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখে। যেমন- যৌন আচরণে অসঙ্গতি কিংবা পরিবর্তন, মাথা কিংবা পেটে ব্যথার কথা বলা, স্কুলে নানা সমস্যার মুখে পড়া এবং ফলাফল খারাপ হওয়া। শিশুর স্বাভাবিক আচরণও বদলে যেতে পারে। যেমন শিশুটি হয়তো খেলাধুলায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, এবং সমবয়সী কিংবা বয়স্কদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নানা সমস্যায় পড়ে। শিশুর আচরণে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে অভিভাবকের উচিত এ সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়া।
শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে এবং এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা নিজেদের কথা প্রকাশ করতে পারবে তখনই, যদি মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভয় কিংবা সংকোচহীন হয়।

শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলতে এখনো আমরা স্বচ্ছন্দ নই। এরকম ঘটনা যে ঘটে তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না। এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটিকেও বলা হয় এ কথা প্রকাশ না করতে। নিপীড়নকারী পরিবারের সদস্য হলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না, যা আরও ভয়াবহ। এর ফলে মা-বাবা সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ মা-বাবার এমন অসংবেদনশীল আচরণে শিশুটি মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

‘পরিবারের সম্মান’ কি নিজের সন্তানের স্বার্থ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন নিয়ে আমাদের নীরবতা ভাঙার এখনই সময়। কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে সে বিষয়ে শিশুদের সচেতন করা, নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে শিশুটিকে সমর্থন দেওয়া এবং নিপীড়নকারী যে-ই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া অভিভাবকদের দায়িত্ব। আমরা কি এই দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট চেষ্টা করছি?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.